প্রশাসনিক জটিলতায় সুন্দরবনের মধু এখন ভারতের ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য

Download Presentation

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের মধুর মূখ্য অংশের সংগ্রহকারী বাংলাদেশ। সুন্দরবন থেকে বাংলাদেশ বাৎসরিকভাবে ভারতের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ মধু আহরণ করে। কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ্য করা যায়, বিশ্ব মেধা সম্পদ সংস্থা (ডব্লিউআইপিও)-র একটি সম্মেলনে (১৩-১৭ মে, ২০২৪) সুন্দরবনের মধুকে ভারতের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে।

এই বিষয়কে সামনে রেখে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) “সুন্দরবনের মধু এখন ভারতের ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য” শিরোনামে ২৬ জুন, ২০২৪ -এ একটি মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন বিশ্ব মেধা সম্পদ সংস্থার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি।

ড. ফাহমিদা খাতুন তাঁর সভাপতির বক্তব্যে বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ এ ভারত টাঙ্গাইল শাড়ীকে তাদের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ঘোষণা দেয়। এই বিষয় নিয়ে সিপিডি ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ এ সম্বন্ধে করণীয় বিষয়ক মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেছিল। এর পরপরই সরকার টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাবার প্রক্রিয়া শুরু করে। এর মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সুন্দরবনের মধুর একক স্বত্ত্ব পাচ্ছে ভারত। একটি পণ্যের ভৌগলিক স্বীকৃতির সাথে শুধু অর্থনৈতিক লাভ বা ক্ষতিই নয় বরং দেশের ঐতিহ্য এবং সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী মানুষের জীবিকাও সংযুক্ত থাকে। দেশীয় পণ্য অন্য দেশের পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হবার পরে ব্যবস্থা না নিয়ে নিবন্ধিকরণের আগেই জিআই দাবী করবার বিষয়ে সক্রিয় হওয়ার সময় এসে গেছে। এই সমস্যা সমাধানে তিনি সংবেদনশীল এবং পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধসম্পন্ন দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রতি গুরুত্ব দেন।

ব্রিফিং এ মূল বক্তা ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের আলোকে তাঁর উপস্থাপনা তুলে ধরেন। এই উপস্থাপনায় তাঁর সহযোগী হিসেবে ছিলেন নাইমা জাহান তৃষা, প্রোগ্রাম অ্যাাসোসিয়েট, সিপিডি।

ড. ভট্টাচার্য তাঁর উপস্থাপনায় ভারতের সাথে বাংলাদেশের অংশীদারিত্বমূলক বিভিন্ন পণ্য এবং তা নিয়ে চলমান দ্বন্দের বিষয়ে উল্লেখ করেন। টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই পাওয়ার জন্য সরকারের সক্রিয় ভূমিকার প্রশংসা করেন তিনি।

মধুর জিআই স্বত্ত্ব নিয়ে তিনি বলেন, মধু বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্য এবং এই মধুকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য প্রায় ৭ বছর আগে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনিক অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে আগে আবেদনের পরও ভারত সুন্দরবনের মধুর জিআই পেয়েছে।

উপস্থাপনায় তিনি আন্তঃদেশীয় সম-জাতীয় বা একই নামের পণ্য নিয়ে হওয়া বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, মেধাস্বত্ত্বের বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজন হলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যেসব অংশীদারিত্বমূলক ভৌগলিক পণ্য আছে তার যথার্থ সুরক্ষার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন এবং লিসবন চুক্তির জেনেভা আইনের অধীনে অংশ নিতে হবে। তবে তিনি ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ যদি স্বল্পন্নোত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণকে টেকসই করতে চায়, তাহলে অবশ্যই মেধাস্বত্বকে সংরক্ষণ করতে হবে। মেধাস্বত্ত্বের সুরক্ষা ছাড়া জ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তি কোনো জায়গায় বিকশিত হতে পারে না। মেধাস্বত্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন প্রয়োজন। শুধু বিদেশি বিনিয়োগের জন্য নয়, নতুন উদ্ভাবকদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্যও মেধাস্বত্ব সুরক্ষা দিতে হবে।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভৌগলিক পণ্যের ঐতিহ্যগত গুরুত্বের সাথে এখানে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও প্রান্তিক উৎপাদকের স্বার্থ জড়িত। পণ্যের জিআই পাবার পর সেই পণ্য বিশ্ববাজারে বাজারজাত করতে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। তা না হলে অর্থনৈতিক সম্বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে না। একই সাথে তিনি ভারত-বাংলাদেশ সমন্বিত অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি (সিইসিএ)-র মধ্যে মেধাস্বত্ত্ব এবং জিআই এর বিষয়টি যুক্ত করার পরামর্শ দেন।

উপস্থিত সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে বর্তমানে সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বত্ত্ব পুনরুদ্ধারের পথ, পণ্যের স্বীকৃতি পাবার পরের কর্মপরিকল্পনা, বাংলাদেশ পেটেন্ট আইন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়।

আলোচনার শেষে ড. ফাহমিদা খাতুন সবাইকে ধন্যবাদ দেন এবং দেশীয় পণ্যের জিআই রক্ষায় নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।