Published in প্রথম আলো on Wednesday 15 July 2020
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে গত ১৭ জুন তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। ভিডিও যোগাযোগের অ্যাপ ‘জুম’–এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ শেষ কিস্তি।
প্রথম আলো: সম্ভাব্য খাদ্যসংকটের ব্যাপারে জানতে চাই। আপনি অবগত আছেন যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন এবং গার্ডিয়ান–এর মতো নেতৃস্থানীয় গণমাধ্যম ও অন্যান্য প্রভাবশালী সংবাদপত্র মনে করছে, বিশ্ব এক তীব্র খাদ্যসংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, যেসব দেশের বিপুল পরিমাণ খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, সেসব দেশও খাদ্য সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্নের কারণে এ সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। তাই যেকোনো সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতি বা খাদ্য সরবরাহজনিত সমস্যা এড়াতে আমাদের সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারে?
রেহমান সোবহান: বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক ভাগ্যবান যে আমাদের কঠোর পরিশ্রমী, সৃজনশীল ও শক্তিশালী এক কৃষকসমাজ রয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কৃষকেরা খাদ্য উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়িয়েছেন। তাঁরা যে শুধু কয়েক গুণ খাদ্য উৎপাদন করে চলেছেন, তা নয়, বরং ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো ও একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে নিজেদের সক্ষমতা দেখিয়ে চলেছেন। শুধু প্রচলিত খাদ্যশস্যের উৎপাদন নয়, আরও বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষিপণ্যের উৎপাদনও করছেন; আর এখন অগ্রসর হচ্ছেন গবাদিপশুর খামারের দিকে। তাঁরা আ
মাদের গবাদিপশু ও মৎস্যজাত পণ্যের মান বাড়িয়েছেন। সীমিত সরকারি বিনিয়োগে ভর করে আমাদের কৃষকেরা যে এসব করতে পারছেন, তা থেকে বিরাট দক্ষতার বিষয়টি ফুটে ওঠে।
দুনিয়ায় যা–ই ঘটতে চলুক না কেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সামনের দিনগুলোতে আমাদের প্রয়োজন মেটানোর সক্ষমতা এ দেশের কৃষকের আছে। তবে আমাদের অবশ্যই তাঁদের পূর্ণ সহযোগিতা দিতে হবে। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন সার ও কীটনাশক পাওয়ার সুবিধা তাঁদের থাকবে। সরবরাহ ও বিতরণব্যবস্থা কাজ করছে—এ বিষয়ও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
কোভিডের সময়কালে সরকারকে বণ্টনব্যবস্থা ধরে রাখতে হবে। এমনকি সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে হলেও বাজারে খাদ্যপণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের জন্য প্রণোদনাব্যবস্থা চালু রাখার দিকে আমাদের নজর দেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যাতে কম দামের কারণে ও সরবরাহ করতে না পারার জন্য তাঁরা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য ছুড়ে না ফেলেন। এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা ও কৃষকদের পণ্যের মূল্য নিশ্চিত করা সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। কৃষকেরা সব খাতে পণ্যমূল্য পাচ্ছেন, তা দেখতে বাজেট ও সম্পদের একটা অংশ বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, যাতে বিশেষ করে কখনো আমরা আমাদের সরবরাহব্যবস্থায় আন্তর্জাতিকভাবে সংকটে পড়লে পণ্যের উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে কৃষকদের প্রণোদনা দিতে পারি।
কিছু ক্ষেত্রে কৃষিপণ্যের কাঁচামালের জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক সরবরাহ উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে ও নির্দিষ্ট এই ক্ষেত্রে আমরা কতটা আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে পারি, সে দিকটা দেখতে হবে। বিদেশি উৎসের ওপর নির্ভরশীল সরবরাহব্যবস্থার যেসব অংশ এখনো সুচারুভাবে চলছে, সেদিকেও যত নজর দেওয়া যায়, দিতে হবে। তবে সরকারের প্রধান কাজ হবে অবশ্যই কৃষকদের অর্থনৈতিক, উপকরণগত ও প্রশাসনিক সব ধরনের সহায়তার দিকে নজর দেওয়া; যাতে তাঁরা এখন যে উঁচু পর্যায়ের উৎপাদন করে যাচ্ছেন, সেটা শুধু বজায় না রাখেন, বরং নিজেদের উৎপাদন বাড়িয়ে নেওয়ার পথে এগোতে পারেন।
প্রথম আলো: নোবেল বিজয়ী জোসেফ স্টিগলিৎজ সম্প্রতি তাঁর লেখা একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, কোভিড–১৯ একটি শক্তিশালী রিমাইন্ডার হিসেবে কাজ করেছে। মনে করিয়ে দিয়েছে, মৌলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে এখনো নেশন স্টেট বা জাতিরাষ্ট্র রয়ে গেছে। আপনি কি মনে করেন করোনা সংকট গণতন্ত্রের ঘাটতিকে আরও গভীর করবে? গণতন্ত্রীকরণের প্রশ্ন আরও প্রান্তিকতার মুখে পড়বে? কীভাবে দেখেন?
রেহমান সোবহান: আমি মনে করি, স্টিগলিৎজ অবশ্যই এটা বলতে চাইছেন, বিশ্বায়নের অধীন আমরা সবাই ক্রমে আরও বেশি বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। কিন্তু যখন এ বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা জাতিরাষ্ট্রের কাছে ফিরতে বাধ্য হই। যখন আমরা আমাদের জাতিরাষ্ট্রের কবজায় ফেরত যাই, তখন রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের পুরোটা আরও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় হয়ে ওঠে। এটা এমন যে আমাদের সাধারণ নাগরিক, যাঁরা বিশ্বায়নের সঙ্গে ততটা কার্যকরভাবে যুক্ত নন, তাঁদের চাহিদার প্রতি সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই এখানে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হয়; যেখানে সমাজের কম সুবিধাভোগী গোষ্ঠীগুলোকে—
ক. প্রবৃদ্ধি থেকে আসা সুবিধার আরও বেশি ভাগ দেওয়ার প্রয়োজন হবে,
খ. সরকারি সম্পদ ব্যয় করার মাধ্যমে আরও অধিকতর সহায়তা ও সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন হবে।
সম্প্রতি একটা ধারণার প্রত্যাবর্তন নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। আর সেটা হলো নাগরিককে একটি অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক আয়ের নিশ্চয়তা দিতে হবে, যেখানে সব নাগরিককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এমনকি উন্নত অর্থনীতির দেশেও নাগরিকেরা মৌলিক আয়ের নিশ্চয়তা পাবেন। এর ফলে বিশ্বায়ন বা এমনকি কোভিডের কারণে যৎসামান্য আয়–উপার্জন করা পরিবার বা আয়ের পথ হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া লোকজনের চাহিদা মিটবে। এই বিষয়গুলো হলো তেমনই কয়েকটি বিষয়, যা বিবেচনা করার দাবি রাখে।
স্টিগলিৎজ, আমি এবং আরও অনেকে যুক্তি দিয়েছেন যে এটা কোভিডের কারণে হোক আর বৈশ্বিক ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান অসমতার কারণে হোক, অর্থনৈতিক সুযোগ–সুবিধার গণতান্ত্রিকীকরণ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে, যাতে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা, বাজারব্যবস্থায় সমতাভিত্তিক ও প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণ এবং সম্পদের মালিকানা ভোগের ক্ষেত্রে সব শ্রেণির মানুষ একই অধিকার পান। কোভিড পরিস্থিতি থাকুক আর না থাকুক, ২১ শতকের অ্যাজেন্ডায় এর সব কটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
প্রথম আলো: হার্ভার্ডের অধ্যাপক কারমেন এম রেনহার্ট বলেছেন, এটি বিশ্বায়নের কফিনে আরেকটি পেরেক। আরেক মার্কিন অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম পোজেন বলেছেন, বাকি বিশ্ব থেকে নিজেদের অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন করতে সরকারগুলোকে ক্রমেই বেশি চালিত করবে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। আপনি দেখে থাকবেন, মহাদেশগুলোজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ কীভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, সাম্প্রতিক অতীতে আমরা তার সাক্ষী হয়েছি। এখন আমাদের আশঙ্কা, এটি আমাদের দুই প্রধান আর্থিক খাত রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাক রপ্তানিকে আরও প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দিতে পারে। বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে প্রান্তিকীকরণের এই প্রক্রিয়া আরও গতিশীল হতে পারে এবং আমাদের অর্থনীতির প্রথম সারির প্রধান দুই খাত আরও বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে কি না—বিষয়গুলো কীভাবে দেখেন?
রেহমান সোবহান: এ রকম ঝুঁকির আশঙ্কা সব সময়ই আছে। তবে এটা ধারণা করা হয়, কোভিড মহামারি চিরকাল চলতে থাকবে। আমি মনে করি না, এটা সম্ভব। আমার ধারণা, আগামী বছর বা ওই রকম কোনো এক সময়ে আমরা এ মহামারি থেকে বিশ্বের মানুষকে রক্ষায় টিকা পেয়ে যাব ও ব্যবসা–বাণিজ্যে ফিরতে পারব। আমরা যখন কোভিডমুক্ত একটি বিশ্বে ফিরব, তখন আরব বিশ্বের যেসব দেশ জনশক্তি আমদানিনির্ভর, তারা আমদানি করা জনশক্তিনির্ভরতা কমাতে পারবে, এমনটি নয়। তখন নিজেদের অর্থনীতি ও সেবা কার্যকরভাবে সচল রাখতে বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি বা ভারতীয় বা ফিলিপিনো শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার না দিলে পুরো সমাজই ভেঙে পড়বে। একই ঘটনা বিশ্বের আরও অনেক দেশের জন্য প্রযোজ্য, যেখানে তাদের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক চরিত্র হলো, বিভিন্ন ক্ষেত্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সব সময় আমদানি করা জনশক্তির ওপর নির্ভর করা। ওই সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এমন যে এগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মেটানো সম্ভব নয়। দিন শেষে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিকভাবে অনেকাংশে অসচেতন ওই সব জনগোষ্ঠী, যারা মি. ট্রাম্পকে সমর্থন জানায় ও গতানুগতিক শিল্পকারখানাগুলোতেই কাজ করে। দেশে নতুন প্রতিষ্ঠিত পোশাক কারখানায় তাদের চাকরি খোঁজার সম্ভাবনা কমই। তাই তৈরি পোশাক বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতেই তৈরি হতে থাকবে এবং এ পোশাক ও অন্যান্য পণ্য, যা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অপরিহার্যভাবে শ্রমঘনিষ্ঠ, তা সরবরাহে আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়েই রইব। তাই উৎপাদনের সক্ষমতায় এবং যে পথে বৈশ্বিক জনশক্তি প্রকৃতই কাজ করে থাকে—এ উভয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন চলতে থাকবে ও আন্তনির্ভরতার উপকরণগুলোও বজায় থাকবে।
আমি মনে করি, আমরা ভালোভাবে খেয়াল করলে, বিশেষ করে এশিয়া অঞ্চলের দিকে তাকালে দেখব, আমাদের বৈশ্বিক আন্তনির্ভরশীলতা অনেকটা এশিয়াকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে। পর্যায়ক্রমে আমরা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ওপর কম নির্ভরশীল হয়ে পড়ব। কারণ, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা এখন আর বিশ্বের দ্রুত বিকাশমান অঞ্চল নয়। বরং নিজেদের মধ্যে অধিকতর প্রতিযোগিতার কারণে এখন এশিয়ার দেশগুলো বিকাশমান অঞ্চলে পরিণত হয়েছে, বিশেষত চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া। এ দেশগুলো আমাদের সরবরাহের প্রধান উৎস হতে চলেছে ও শেষমেশ আমাদের প্রধান বাজারও। ভবিষ্যতের জন্য এশিয়া অঞ্চলকে নিয়ে আমাদের আরও বেশি সহযোগিতামূলক ও সমন্বিত অর্থনৈতিক সম্পর্কের কাঠামো তৈরির পরিকল্পনা করতে হবে।
উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও প্রধানত উন্নয়নশীল বিশ্বের ভেতরেই পরস্পরের সঙ্গে সমানতালে মজবুত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হবে। আফ্রিকার প্রধান বাণিজ্য অংশীদার, এমনকি অনেক লাতিন আমেরিকার দেশের জন্যও এখন তাদের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হলো চীন; যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ নয়। এসব নতুন অর্থনৈতিক যোগাযোগ ২১ শতকের ও কোভিড–পরবর্তী বিশ্বের জন্যও নতুন বাস্তবতা হতে চলেছে। বিশ্বের কোনো অংশে যদি গুরুতর সমস্যা থেকে থাকে, তবে সেটি রয়েছে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা অংশে। বিশ্বায়ন সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত আছেন, ওই দেশগুলোর এমন পণ্ডিতেরা নিজেদের দেশের পরিস্থিতি ভাবনায় রাখছেন। আমাদের পরিস্থিতি নিয়ে আমি অতটা হতাশাবাদী নই। কেননা, আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ নীতি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিচালনা করি এবং এশীয় অঞ্চলে আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে আরও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক ও সরবরাহব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় নিজেদের সামর্থ্যের উন্নয়ন ঘটাই।
প্রথম আলো: কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, কোভিড–১৯ মহামারি একটা পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করবে, যা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এই পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্বায়ন থেকে আরও বেশি চীনকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের দিকে ধাবিত করবে। প্রশ্ন হলো, এর প্রভাব, সম্ভাব্য প্রভাবকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন বা এই পরিবর্তনের গুরুত্ব বিশেষত দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর কেমন হতে পারে মনে করেন?
রেহমান সোবহান: আমি এরই মধ্যে আগের প্রশ্নে এর আংশিক উত্তর দিয়েছি যে এটা ইতিমধ্যে ঘটতে শুরু করেছে। এটা চলতে থাকবে। বিশ্বে বৃহৎ আয়তনের দেশগুলোর মধ্যে চীন সবচেয়ে দ্রুত অগ্রসরমান দেশ, নিঃসন্দেহে বিশ্ব ইতিহাসেও। চীন এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে নিজের সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। বর্তমানে দেশটি বৈশ্বিক পুঁজির প্রধান উৎসও হয়ে উঠেছে। তাদের এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ ট্রিলিয়ন (৩ লাখ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই অর্থ দিয়ে তারা বৃহৎ বাজেট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতির অর্থায়ন করছে। নিজস্ব প্রতিযোগিতা সক্ষমতার কারণে চীনা উদ্বৃত্ত পুঁজি বিশ্বের বৃহত্তমই থেকে যাবে।
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ সব সময় ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আসা পুঁজিপ্রবাহের প্রধান উৎসগুলোর ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ অবস্থা এখন আর নেই। এখন পুঁজির প্রধান উৎসগুলো চীনে অবস্থিত। আমি মনে করি, ভারতও টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন ও প্রকৃত সক্ষমতার চেয়ে বেশি কিছু করতে পারে এবং বাংলাদেশের জন্য পুঁজি, প্রযুক্তি ও সরবরাহের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসও হয়ে উঠবে। যত দূর জানি, আমরা অনেক ভালো অবস্থানে আছি। কারণ, আমরা দেশ দুটিকে আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে পেয়েছি। এদের একটি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ও অন্যটি বিশ্বে তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আমরা যদি বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতার সঙ্গে আমাদের অবস্থানের সুযোগ নিতে পারি, তা এ দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের রূপান্তর ঘটাবে। আমাদের একটা এশীয় অর্থনৈতিক কমিউনিটি নির্মাণকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করা উচিত, যে কমিউনিটির সদস্য হয়ে আমরা এমন একটি বিশ্বে থাকব, যেখানে আমাদের অর্থনৈতিক দুনিয়ার কেন্দ্র হবে এশিয়া; যেখানে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার ভারসাম্য উত্তর আমেরিকা ও উত্তর আটলান্টিক অঞ্চল থেকে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসগারীয় অঞ্চলের দিকে ধাবিত হবে।
প্রথম আলো: আপনার শেষ উত্তর থেকে একটা সম্পূরক প্রশ্ন রাখছি। আপনি জানেন, কিছু সীমান্ত ইস্যু, উত্তেজনা, কখনো গোলাগুলি, যেমন গত সপ্তাহে আমরা দেখেছি, তা সত্ত্বেও চীন ও ভারত নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করছে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াচ্ছে। একই সময় আমরা ভারতের নেতৃস্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি এক নিবন্ধে এমন মন্তব্য করতে দেখেছি, যেখানে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে ইঙ্গিত করে চীনের দিকে বেশি না ঘেঁষতে সতর্ক করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশের জন্য একটা ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে করা যায়?
রেহমান সোবহান: হ্যাঁ, আমি মনে করি, একটা ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটি অব্যাহত রাখার ব্যাপারে তাঁকে আমার পূর্ণ উৎসাহ দিতে হবে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং এশিয়ার সব দেশের স্বার্থে। যেখানে ভারত ও চীন একটা অধিকতর সম্প্রীতির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে; এ জন্য যে প্রকৃতপক্ষে ভবিষ্যৎ বিশ্বব্যবস্থা নির্ভর করছে এই দুই দেশের সম্পর্কের ওপর। ঐতিহ্যগত বৃহৎ পশ্চিমা শক্তিগুলো, যারা আমাদের শাসন করেছে, তাদের অনেক বড় একটি স্বার্থ ভারত ও চীনকে বিভক্ত রাখা। এরা বিভক্ত আছে—তা দেখতে শক্তিগুলো তাদের সামর্থ্যে যা আছে, তা দিয়ে সবকিছু করবে। বৃহৎ এ দুই দেশকে একত্রে কাজ করতে হলে রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বগুণে জ্বলে ওঠা প্রয়োজন।
পণ্ডিত নেহরু ও চৌ এন লাই তাঁদের জীবনের একটা পর্যায়ে এক নতুন এশিয়া গড়তে ভারত ও চীনকে এক সুতায় বাঁধার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে পণ্ডিত নেহরু এশিয়ার সম্পর্ক বিষয়ে দিল্লিতে এক সম্মেলন আহ্বান করেন। উপনিবেশ–পরবর্তী বিশ্বের একটি চিত্র তুলে ধরতে এটি ডেকেছিলেন তিনি, যে বিশ্বে এশিয়ার দেশগুলো এক হয়ে একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবে। আমি মনে করি, এটাই বাস্তবে হওয়া উচিত এবং আমি দেখতে চাইব, ভারত ও চীন উভয় দেশের নেতারা রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রজ্ঞা ও দক্ষতা দেখাবেন। তাঁরা যাতে নিজেদের এই প্রজ্ঞা ও দক্ষতা দেখাতে পারেন, সেই উৎসাহ জোগাতে বাংলাদেশ ও অন্য এশীয় দেশগুলোর সম্ভাব্য সবকিছু করা প্রয়োজন, যাতে তাদের সীমান্ত নিয়ে আজকের সংকট তৈরির পেছনে থাকা সমস্যাগুলো তারা সমাধান করতে পারে।
প্রথম আলো: শেষ প্রশ্ন, আমি মনে করি, আপনি আপনার খুব ভালো বন্ধু অমর্ত্য সেনের ধারণার সঙ্গে একমত হবেন। তিনি বলেছেন, ‘গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেওয়ার বদলে সরকার জনগণের আলোচনা থেকে দারুণভাবে সহায়তা পেতে পারে। কোনো বৈশ্বিক মহামারি কাটিয়ে ওঠা একটা যুদ্ধে লড়াই করার মতো মনে হতে পারে; কিন্তু প্রকৃত প্রয়োজন এর চেয়ে অনেক বেশি।
রেহমান সোবহান: আমি আমার বন্ধু অমর্ত্য সেনের সঙ্গে দুই শ ভাগ একমত। কেননা, আমি সারা জীবন জনগণের সংলাপে বিশ্বাস করেছি। আর এটা বিশ্বাস করেছি, একটা দেশ যেসব সমস্যার সম্মুখীন, সেসব গঠনমূলকভাবে তুলে ধরতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ স্বাধীন গণমাধ্যম যেকোনো সরকারেরই সেরা বন্ধু, বিশেষত সংকটময় মুহূর্তগুলোতে। দক্ষিণ এশিয়া ও এর বাইরের দেশেও সংকটের মুহূর্তগুলোতে সরকারের মধ্যে সব সময় তথ্য গোপন করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু সংকটকালে আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো প্রকৃত ঘটনা ও সত্যকে আড়াল করা। পরিস্থিতির সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাগুলোতে আলো ফেলতে পারে গণমাধ্যম। কোনো সরকারকে এর চেয়ে বৃহত্তর সেবা অন্যভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। আমার মতে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নিয়মিতভাবে আমাদের সরকার ও অন্যদের পুরস্কৃত করা উচিত, যাঁরা মানুষের উদ্বেগের সমস্যাগুলো, যা সরকারের নজরে আনা দরকার, তা তুলে ধরেন।
প্রথম আলো: আপনাকে ধনবাদ।
রেহমান সোবহান: ধন্যবাদ।
মূল সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে নেওয়া।
ইংরেজিতে সাক্ষাৎকারটি পড়ুন প্রথম আলোর ইংরেজি অনলাইনে। www.en.prothomalo.com
বাংলা অনুবাদ: আবু হুরাইরাহ্ ও রাজিউল হাসান
আরও পড়ুন: ১০টি সিএমএইচ মানের হাসপাতাল করা জরুরি