Originally posted in বণিক বার্তা on 9 February 2024
প্রাণিসম্পদ খাতে মোট কর্মসংস্থানের ৮৮ শতাংশই নারী
দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের প্রধান চালিকা শক্তি এখন নারী। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের শ্রমে ভর করে এগোচ্ছে দেশের গবাদিপশু ও পোলট্রির সম্প্রসারণ কার্যক্রম। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৮৮ দশমিক ২ ও পুরুষের মাত্র ১১ দশমিক ৮ শতাংশ।
প্রতিবেদনটিতে শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭-এর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ১৪ দশমিক ৫ শতাংশই প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। আর কৃষি খাতের কর্মসংস্থানের মধ্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অংশ ৩৫ শতাংশ। এছাড়া দেশের মোট পুরুষ কর্মসংস্থানের মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে কাজ করছে আর নারীদের মোট কর্মসংস্থানের ৪১ শতাংশই প্রাণিসম্পদসংশ্লিষ্ট খাতে।
খাতসংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ পরিবারেই হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু লালন-পালন করা হয়। সাধারণত বাড়ির নারীরাই এগুলোর দেখাশোনা করেন। নারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হলে সামনের দিনগুলোয় এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে তারা আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ খাতেও উৎপাদন বাড়বে।
গ্রামাঞ্চলে অনেক নারী এখন পশু ও হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমে পরিবারের সচ্ছলতায় ভূমিকা রাখছেন। তাদেরই একজন রংপুরের মাহিগঞ্জ থানার রোকসানা বেগম। শ্বশুর-শাশুড়িসহ ছয় সদস্যের পরিবার। বাড়িতেই ডেইরির পাশাপাশি হাঁস-মুরগির খামার দেখাশোনা করেন। খামারে মোট আটটি গরু ও ৩০-৩৫টি হাঁস-মুরগি রয়েছে। গরুর দুধ থেকে নিজেই আবার দই উৎপাদন করেন।
রোকসানা বেগম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নারীরা পরিবারের দেখাশোনার পাশাপাশি হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু লালন-পালন করতে পারেন। এতে তারা পরিবারের আয়েও বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। এতে ঘরে বসে থেকেই আয় করার সুযোগ রয়েছে। নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই খামার ছোট করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। আগে লাভ হলেও বর্তমানে খুব বেশি লাভ করা যাচ্ছে না।’
প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও এতে মালিকানায় তারা পিছিয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড হাউজহোল্ড সার্ভে ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের বড় আকারের গবাদিপশুর (গরু-মহিষ) ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ মালিকানাই রয়েছে পুরুষের হাতে আর নারীর মালিকানায় রয়েছে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
আবার ছোট গবাদিপশুর (ছাগল-ভেড়া) ক্ষেত্রে পুরুষের মালিকানায় আছে ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ আর নারীর মালিকানায় আছে ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে হাঁস-মুরগির ক্ষেত্রে নারীর মালিকানা ৮৩ দশমিক ৮ ও পুরুষের ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নারীরা পারিবারিকভাবে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি দেখাশোনা করেন। বাড়ির কাজ যেমন অবৈতনিক তেমনি পারিবারিক গবাদিপশু বা হাঁস-মুরগি লালন-পালনও অবৈতনিক। এটা তাদের সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান নয়। বৃহত্তর পারিবারিক কাজের অংশ হিসেবেই তারা এটা করে থাকেন। স্বাবলম্বী করতে হলে নারীদের মালিকানা দিতে হবে। কিন্তু পারিবারিকভাবে দেখাশোনা করলে নারীরা মালিকানা পান না। যত বেশি উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের সম্পৃক্ত করা যায় তত বেশি তারা স্বাবলম্বী হবেন। অর্থাৎ নিজের টাকায় গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি কিনতে হবে।
প্রাণিসম্পদ খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও তাদের শ্রমমূল্য পাচ্ছেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়ির কাজ দেখাশোনার পাশাপাশি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি দেখাশোনা করেন তারা। এজন্য তাদের শ্রমমূল্য আলাদাভাবে পরিশোধ করা হয় না। কোথাও চাকরি হিসেবে কাজ করলেও শ্রমমূল্য থাকে অনেক কম।
রংপুর সিটি করপোরেশনের ৯ নং ওয়ার্ডের বাহারকাচনা এলাকার বাসিন্দা মেহেরা বেগম (৫৫)। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দীর্ঘদিন অসুখে শয্যাশায়ী থেকে মৃত্যুবরণ করেছেন স্বামী। মেহেরা বেগম জানান, আগে স্থানীয় মুরগি খামারে পার্ট-টাইম কাজ করে ৫ হাজার টাকা পেতেন। তা দিয়ে সংসারের খরচ কোনোমতে চালিয়ে নিতেন। স্বামীর অসুস্থতার কারণে কিছুদিন কাজে বিঘ্ন হলেও আবার তিনি নিয়মিত হচ্ছেন।
খামার মালিক আরমানুর রহমান জানান, মেহেরা বেগম তার খামারে সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পযন্ত কাজ করেন। কাজ বলতে ডিম সংগ্রহ এবং খামারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। তার খামারে মুরগি আছে ২ হাজার ২০০-এর মতো।
তবে নারীদের অনেকে উদ্যোক্তা হিসেবেও বাণিজ্যিকভাবে হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু লালন-পালন করছেন। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দহকুলা গ্রামের লাবিবা পোলট্রি খামারের স্বত্বাধিকারী ও নারী উদ্যোক্তা শাহিদা বেগম বণিক বার্তাকে জানান, ছয়-সাত বছর ধরে নিজ বাড়িতে পোলট্রি খামার করছেন। পাঁচ হাজার ক্ষমতাসম্পন্ন খামারে এখন তিন হাজার মুরগি রয়েছে। প্রথমে স্বল্পপরিসরে করলেও পরে সোনালী ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখা থেকে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে খামার বাড়িয়েছেন তিনি। এখন প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। তবে এর আগে কিছু লোকসানও হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডাক্তার এসএম মাহবুবুর রহমান জানান, পোলট্রি শিল্পে নতুন নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। এসব নারী সাংসারিক কাজের পাশাপশি পোলট্রি উৎপাদন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সামাজিকভাবে আমাদের দেশে পরিবারগুলোর কর্তা পুরুষ। সে কারণে প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও পুরুষরাই বেশি মালিকানায় রয়েছেন। এক্ষেত্রে মালিকানার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশীদারত্ব বাড়ানো। সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তার জন্য বিভিন্ন স্থানে নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘খাদ্য মোট তিন ধরনের। দানাদার, শুকনো খড় ও ঘাস। অনেক সময় যে পরিমাণ খাবার খাওয়ানো প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি খাওয়ানো হয়। আবার ওষুধও মাঝেমধ্যে বেশি ব্যবহার করা হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়। আমরা উদ্যোক্তাদের কীভাবে কম খরচে উৎপাদন করা যায় তার প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন রংপুর প্রতিনিধি এসএম পিয়াল ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি গোলাম সরোয়ার)