স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ – বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য এই পরিমাণ খুবই অপ্রতুল: ফাহমিদা খাতুন

Published in বিবিসি বাংলা on Wednesday 1০ June 2020

করোনা ভাইরাস: স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ ও ব্যয়ের সংকট কী কাটবে?

সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিযোগ, তাদেরকেও অনেক প্রতিকূলতা এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দেশের নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্রটি বেরিয়ে এসেছে। একদিকে যেমন মহামারি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির স্বাস্থ্যখাত, সেই সঙ্গে এর নানা দুর্বলতার বিষয়টিও সামনে এসেছে।

জুন মাসে বাংলাদেশে জাতীয় বাজেটের আলোচনায় তাই কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাস্থ্য খাত।

অনেকেই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অনেকে আবার বলছেন, শুধুমাত্র বরাদ্দ বাড়িয়ে স্বাস্থ্যখাতের নাজুক অবস্থার পরিবর্তন হবে না, এজন্য দরকার বরাদ্দ বাস্তবায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কার্যকর ব্যবহার।

সেই সঙ্গে বহু বছর ধরেই স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থহীন ব্যয়ের অভিযোগও উঠছে। সরকারি স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশার কারণে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে বেসরকারি বিশাল একটি চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা। যেখানে চিকিৎসা সেবা নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ

বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় অন্যান্য খাতের তুলনায় স্বাস্থ্যখাত বাজেটে বরাবরই কম গুরুত্ব পেয়ে আসছে।

২০১৯-২০২০ সালের চলতি বাজেটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির মাত্র ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থ মূল্যে যার পরিমাণ ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। পুরো বাজেটের আকারের তুলনায় তা ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ পরিবহন ও যোগাযোগ খাত পেয়েছে বাজেটের ২৬ দশমিক ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাত পেয়েছে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

আগের বছর ছিল জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ডে ব্যয় করা হয় জিডিপির ৯ শতাংশ।

জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্যা প্যাসিফিকের (এসকাপ) ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপির বিচারে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়া হয় বাংলাদেশ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ”বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য এই পরিমাণ খুবই অপ্রতুল। এ খাতে মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ১ হাজার ৫৩৭ টাকা। এ কারণে মানুষকে নিজের পকেট থেকে প্রায় ৬৬ শতাংশের মতো খরচ করতে হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ৩৪ টাকা এবং বাকি ৬৬ টাকা রোগী নিজে বহন করে। এই টাকা খরচ করা অনেক মানুষের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।”

বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত শয্যা ও আইসিইউর অভাব রয়েছে

চিকিৎসার চেয়ে অবকাঠামো ও ক্রয়ে বড় খরচ

স্বাস্থ্য খাতের খরচের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একদিকে বাজেটে যেমন বরাদ্দ কম, অন্যদিকে এই বরাদ্দের যতটা না চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়, তার চেয়ে বেশি খরচ হয় ভৌত অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ ও বেতন-ভাতার পেছনে।

চলতি বছরের মোট বরাদ্দ ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকার মধ্যে ১৩ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা চলে গেছে পরিচালন খাতে। এর মাত্র এক চতুর্থাংশের মতো বরাদ্দ হচ্ছে ওষুধ ও সরঞ্জাম কেনার পেছনে। বাকি অর্থ চলে যাচ্ছে বেতন-ভাতায়, যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এখনো চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা অনেক কম।

জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহবায়ক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলছেন, ”সক্ষমতার অভাব, কিছুটা দুবৃর্ত্তায়ন আছে, একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে যারা এগুলো অপচয় করে -সবকিছু মিলে আমূল সংস্কার দরকার। সংস্কার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ছাড়া বরাদ্দ বাড়ালেও স্বাস্থ্যখাতে পরিবর্তন আসবে না।” তিনি বলছেন।

”অবকাঠামো কিছু আছে, কিন্তু সেখানে কাজ হচ্ছে না। রোগীর চাপ অনেক বেশি, কিন্তু তাদের জন্য মানসম্পন্ন চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই। রোগীর জন্য যে বরাদ্দ, সেটাও কিন্তু খুবই কম।”

সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১,৩১৬টি। আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫,০৫৫টি, যেখানে মোট শয্যার সংখ্যা ৯০,৫৮৭টি।

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে অনুমিত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ।

সেই হিসাবে প্রতি ১,১৫৯ জন ব্যক্তির জন্য হাসপাতালে একটি শয্যা রয়েছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ”যে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়, সেটাও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয় না। সেটা মূলত ভৌত অবকাঠামো, প্রশাসনিক ব্যয়, বেতন-ভাতা ইত্যাদিতে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে রোগীর সেবার জন্য বরাদ্দ খুবই কম।

”একদিকে বরাদ্দ কম, অন্যদিকে বাস্তবায়নের হার কম, অন্যদিকে ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা- এই সমস্যাগুলোর যদি সমাধান না হয়, তাহলে স্বাস্থ্যখাতের যে দৈন্যদশা, তা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পারবো না,” বলছেন ফাহমিদা খাতুন।

বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসক, সেবিকা, টেকনিশিয়ানের সংকট রয়েছে

বড় সমস্যা দুর্নীতি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের দুর্নীতির খানা জরিপে অনেকবার শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের নাম উঠে এসেছে।

টিআইটি সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ খাতগুলোর একটি স্বাস্থ্যখাত, যেখানে দুর্নীতির হার ৪২.৫ শতাংশ।

২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা-নিয়োগসহ দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কাছে একটি প্রতিবেদন দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। সেখানে স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটা, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসা সেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ ১১টি খাতকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যখাতে কোন সংস্কার বা পদক্ষেপের কথা শোনা যায়নি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, জিডিপির সবচেয়ে কম বরাদ্দ, এসব কারণে স্বাস্থ্যখাত যে একটা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে, এখন সেটার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের ক্রয়ে যে দুর্নীতি, সেসব কারণে স্বাস্থ্য খাতের সেবার মান বরাবরই উপেক্ষিত ছিল। সম্প্রতি সেটার আরো অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন এন ৯৫ মাস্ক ক্রয় কেন্দ্রিক ঘটনা। সেখানেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।”

”যারা এসব নানা অনিয়মের সাথে, দুর্নীতির সাথে জড়িত, তারা দুই কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। কারণ তারা প্রভাবশালী মহলের সাথে জড়িত, সেই সঙ্গে যোগ হয় প্রশাসনের আমলা বা কর্মকর্তাচারীদের একাংশ।

”এ কারণে এদের মধ্যে যারা জড়িত তাদের যদি বিচারের আওতায় আনা যায়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তাহলেই বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বাড়তি যে বরাদ্দের কথা বলা হচ্ছে, সেটা অর্থবহ হবে। না হলে সেই আগের ধারাবাহিতা অব্যাহত থাকবে, মানুষ সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে,” বলছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলছেন, স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে সরকারের কোন বিকল্প নেই। সেজন্য হয়তো আরো বরাদ্দ বাড়াতেই হবে। কিন্তু সেটা করতে গেলে অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত করতে উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে, সরকারি অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দুর্নীতি প্রতিরোধ মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ হাবিবুর রহমান বলছেন, ”স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা দেখার জন্য সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। আমি মনে করি, বিভিন্ন কমিটি দায়িত্বে রয়েছে, তাদের কিছুটা দায়দায়িত্ব রয়েছে। যখন কোন কিছু ক্রয় করা হবে, যারা অনুমোদন দেবেন, যারা পরীক্ষানিরীক্ষা করবেন- সকল পর্যায়ে সবাই যদি ভালো করে সময় দেন, তাহলে কেউ (দুর্নীতি) করার সুযোগ পাবেন না।”

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দেশের নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্রটি বেরিয়ে এসেছে।

বরাদ্দ খরচে অক্ষমতা

চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) স্বাস্থ্যখাতে ১৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও, খরচ করতে না পারায় সংশোধিত এডিপি ১০ হাজার ১০৮ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।

কিন্তু এই বরাদ্দেরও পুরোটা ব্যবহার করতে পারে না বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। এই বছরেও যেমন বরাদ্দ থেকে অব্যবহৃত হওয়ায় এক হাজার কোটি টাকা ফেরত যাচ্ছে।

জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহবায়ক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলছেন, ” টাকা বাড়িয়েও যদি সেটা খরচ করা না যায়, তাহলে তো টাকা বাড়িয়েও কোন লাভ নেই।”

” আগে সেটা ঠিক মতো খরচ করার, কাজে লাগানোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শুধু বরাদ্দ দিলেই তো হবে না, সেটা কীভাবে কাজে লাগানো হবে, সেটাও তো নিশ্চিত করতে হবে। আপনি একটা যন্ত্র কিনে দিলেন, কিন্তু সেটা ব্যবহারের লোক না থাকলে তো কাজে লাগবে না।”

”বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে, সেই সঙ্গে সেটা খরচ করার ক্ষমতাও বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যখাতের ফেব্রিক্সটা কিন্তু হতচ্ছিন্ন। এই ফেব্রিক্সটা ঠিক করতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসার ঘাটতির কারণেই বাংলাদেশে এখন এতো বড় করে প্রাইভেট চিকিৎসার ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। সরকারের সেই ঘাটতি পূরণ করতে হবে,” বলছেন ডা. রশিদ-ই মাহবুব।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ হাবিবুর রহমান বলছেন, ”সরকারি যেকোনো অর্থব্যয়ের কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। আসলে বাজেট ঘোষণার পর প্রকল্প শুরু করতে একটু সময় লেগে যায়, তাই অনেক সময় পুরো বরাদ্দ খরচ করা যায় না। আমি মনে করি, প্রকল্পগুলো যদি আগেভাগে শুরু করা যায়, তাহলে বরাদ্দ পুরোপুরি কাজে লাগানো যাবে।”

”স্বাস্থ্যখাতের দক্ষতা বাড়াতে সরকারের অনেক প্রচেষ্টা আছে। সংস্কারের পরিকল্পনা তো বরাবরই থাকে, এখনো আছে। নানানভাবে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে সংস্কারের জন্য। স্বাস্থ্যখাতের অনেকগুলো বিষয় অ্যাড্রেস করা দরকার।” বলছেন মি. রহমান।