Published in যুগান্তর on Saturday, 23 December 2017
যুগান্তর রিপোর্ট
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, আমানতকারীর স্বার্থ সংরক্ষণ করা ব্যাংকগুলোর মূল দায়িত্ব। কারণ ব্যাংকে মূল অর্থায়ন তারাই করে থাকেন। ব্যাংকে উদ্যোক্তাদের অর্থ থাকে ১০ শতাংশ। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে উদ্যোক্তারা ব্যবসা করে যাবেন আর ঋণগ্রহীতা ও আমানতকারীদের ঠকাবেন- এটা হতে পারে না। আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষা করা বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু এ স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না। শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
রাজধানীর কাকরাইলে ইন্সটিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে চলা তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের ‘বিশেষ প্রায়োগিক ক্ষেত্রসমূহ’ সেশনে সভাপতির বক্তব্যে ড. আতিউর রহমান আরও বলেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা চলে বিশ্বাসের ওপর, নৈতিকতার ওপর। এ ব্যবস্থাপনায় নৈতিকতা না থাকলে সেটা অর্থপূর্ণ হতে পারে না। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে যারা হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছেন তারা কী সিএসআর (সামাজিক দায়বদ্ধতা) পালন করছেন। আমরা শুধু ব্যাংকের ওপর চাপ দিই। এখন সময় এসেছে যারা কোটি টাকা ঋণ নেন তারা সিএসআর পালন করেন কি না তা দেখার।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, নীতিনির্ধারকদের আত্মতুষ্টি আর বাস্তবায়নকারীদের গাফিলতি সমাজ ও অর্থনীতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তিনি বলেন, সবকিছু ভালো চলছে বলে নীতিনির্ধারকদের জানানো হয়। অনেক কাজ করা হয়েছে; আর কিছু করার দরকার নেই। এ কথা শুনে নীতিনির্ধারকরা আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। এ আত্মতুষ্টি ও গাফিলতি সমাজে, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সর্বত্র বিদ্যমান। সুনামগঞ্জে হাওরে আগাম বন্যার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবছর হাওরে বন্যা হয় এবং বাঁধ ভাঙে। এবার একটু আগাম হয়েছে। যে বাঁধ দেয়া হয় সেটা প্রতিবছর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় এবং ভেঙে যায়। কিন্তু তার আগেই ফসল কাটা হয়। বাঁধ নির্মাণের জন্য বন্যার এক মাস আগে কমিটি করা হয়। এবার সেটি করা হয়নি। এটাই নৈতিকতার স্খলন। যার কমিটি করার কথা তিনি কমিটি করেননি, অর্থাৎ গাফিলতি করেছেন। আর উপরে যারা আছেন তাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, কোনো সমস্যা নেই। সুতরাং তারা আত্মতুষ্টি নিয়ে আছেন। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে (আইডিইবি) বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ‘শিল্প সংক্রান্ত বিষয়াবলী’ শীর্ষক সেশনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
কাজী খলীকুজ্জমান আরও বলেন, দেশে নীতির কোনো অভাব নেই। অনেক ক্ষেত্রে খুব ভালো আইনও আছে। কিন্তু আত্মতুষ্টি আর গাফিলতির কারণে এগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এগুলো সবকিছু প্রধানমন্ত্রীর দেখা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী যেসব নির্দেশ দেন তার সবই ভালো। কিন্তু এগুলো যারা বাস্তবায়ন করবেন তারা কাজ করেন না। আরেকটি বড় সমস্যা বাস্তবায়ন। খুব বড় ভালো বাজেট করা হয়। প্রথম চার মাসে ১০ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন হয় এবং শেষ দু-এক মাসে সব বাস্তবায়ন করা হয়। প্রথমদিকে কাজ না হওয়া যেমন সমস্যা, তেমনি শেষদিকে বেশি বাস্তবায়ন হওয়া আরও বড় সমস্যা। কাজ না হলেও সব টাকা চলে যায়। এ ক্ষেত্রে যারা বাজেট বাস্তবায়ন করেন তাদের চরিত্র ঠিক করা উচিত।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) প্রসঙ্গে কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, এসডিজি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা, সেমিনারে অর্থনীতিবিদ-মন্ত্রীরা জানান এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। কিন্তু এসব তো এসডিজিতে বলা আছে। মন্ত্রী-অর্থনীতিবিদদের বলা উচিত, এটা করেছি, ওটা করেছি। আর অর্থনীতিবিদদের বলা উচিত, লক্ষ্য অর্জনে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে।
‘বাংলাদেশের সংবিধান ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ : ‘কিছু নৈতিক প্রশ্ন’ প্রবন্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন খান বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারকে দিনবদলের সনদ আখ্যা দিয়েছিল। দিনবদল পুরোপুরি যেতে অনেক দূর যেতে হবে। টেকসইভাবে দারিদ্র্য বিমোচন, একমুখী শিক্ষা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, দুর্নীতি রোধ, দখল-জবরদখলের মতো বিষয়গুলো সুরাহা হয়নি। আমলাতন্ত্রের সমস্যা তো আছেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা অবশ্যই আমলাতন্ত্র। সরকার আমলাতন্ত্রকে দায়িত্বশীল করার পরিবর্তে দায়মুক্তি ও আরও ক্ষমতাবান করতে বেশি আগ্রহী। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার দাবি করছে তারা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেছে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটি উচ্চারণ করতে লজ্জাবোধ করে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের কথা উচ্চারণ করে কালেভদ্রে। আর সমাজতন্ত্রকে পাঠিয়েছে নির্বাসনে।
‘শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্পোরেট সংস্কৃতি : ‘টেকসই উন্নয়নে এ যেন এক অশনিসংকেত’ শীর্ষক প্রবন্ধে সিলেট ক্যাডেট কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ জসীম উদ্্দীন বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় এখন কর্পোরেট সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার সব স্তরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কর্পোরেট আদলে পরিচালিত হচ্ছে। যা অনাকাক্সিক্ষত। আর কতিপয় মুনাফালোভী ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিকে লাভের পথ সুগম করে দিচ্ছে রাষ্ট্রকাঠামো। সরকার দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে সুবিধা করে দিতে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের নাকের ডগায় ঢাকা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত মুনাফালোভী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে। কেউ দেখছে না। কেউ কিছু বলছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে এ সংস্কৃতি পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত সেশনে ‘অর্থনীতি ও নৈতিকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর উপস্থাপনের কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তবে তার লিখিত প্রবন্ধে বলা হয়, দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতার হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। এর ফলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সরকারগুলো আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না। তারা স্বৈরাচারী আদলে দেশ চালাচ্ছে। এতে করে মানুষ শঙ্কিত ও সংশয়ে আছে। কারণ, বারবার সরকার বদল করেও তাদের দুর্ভোগ কমছে না, বরং বাড়ছে। তার মতে, দেশে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করে মিন্টু বলেন, উভয় দলে রয়েছে অত্যন্ত বেশি মাত্রায় রাজনৈতিক অপরাধীদের চক্র। আর এ অপরাধ চক্রের বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। অনৈতিক রাজনীতিই দুর্নীতির মূল উৎস।
দারিদ্র্য ও অসমতার সমস্যাসমূহ সেশনের সভাপতির বক্তব্যে সিপিডির ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিনিয়ত মানুষের প্রয়োজন পরিবর্তন হচ্ছে। ১৯৭০ সালে শিক্ষা মূল প্রয়োজনের মধ্যে ছিল না। কিন্তু এখন সবাই শিক্ষাগ্রহণ করছে। তেমনি ২০৩০ সালে ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়তে হলে দারিদ্র্যের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হবে। এই ক্ষুধামুক্ত বলতে কী শুধু পেট ভরে খাওয়াকে বোঝানো হবে না কি পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ খাবার থাকবে। তিনি আরও বলেন, মাথাপিছু আয় বাড়ানোর চাইতে সম্পদের বণ্টন বাড়াতে হবে।
দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সকালে চারটি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর বিষয়বস্তু ছিল- ‘ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত’, ‘বিশেষ প্রায়োগিক ক্ষেত্রসমূহ’, ‘দারিদ্র্য ও অসমতার সমস্যাসমূহ’ এবং ‘মানব মূলধন সংক্রান্ত’। তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৮টি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা অংশ নেন।
আজ সম্মেলনের সমাপনী দিনে ছয়টি সেশন অনুষ্ঠিত হবে। এগুলোয় অংশ নেবেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও পেশাজীবীরা।