২% শুল্ক কমানো হতাশাজনক – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in প্রথম আলো on 9 July 2025

যুক্তরাষ্ট্র গত ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্কের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই বাংলাদেশ সরকার এটি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। প্রধান উপদেষ্টা এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি লিখলেন। সেখানে আমরা কিছু ছাড় দেওয়ার কথা বললাম। পরবর্তী সময়ে আমাদের বাণিজ্য উপদেষ্টা কথা বলেছেন। এরপর ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটেও যুক্তরাষ্ট্র সুবিধা পাবে—এমন কিছু পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও যেসব অশুল্ক বাধার কথা যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, যেমন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা, মেধাস্বত্ব আইন প্রয়োগ প্রভৃতি নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখলাম।

প্রায় তিন মাসের আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে কমে ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আলাপ-আলোচনায় তেমন কোনো সুবিধা আমরা করতে পারিনি।

শুল্ক আলোচনার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যে ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের (চুক্তি) খসড়া পাঠিয়েছিল, সেটার মধ্যে কী ছিল, আমরা কিছুই জানি না। যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা কী ছিল এবং বিনিময়ে কী দেবে বলেছে; বিপরীতে আমাদের (বাংলাদেশের) চাহিদা কী ছিল এবং বিনিময়ে আমরা কী দেব বলেছি—এই চারটি বিষয়ের কোনোটিই আমরা স্পষ্টভাবে জানি না।

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের পর সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশই নাকি সবার প্রথমে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে, এ রকম একটা ধারণা আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু তিন মাস আলাপ-আলোচনা করে এইটুকুই আমরা এখন জানতে পারছি যে শুল্ক মাত্র ২ শতাংশ কমানো গেছে। এটা অবশ্যই হতাশাজনক।

সরকার থেকে জানানো হয়েছে, চুক্তির খসড়ায় একটি নন-ডিসক্লোজার ক্লজ (তথ্য প্রকাশ করা যাবে না এমন ধারা) ছিল। তবে আমি মনে করি সরকার দর-কষাকষির জন্য অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বিশেষ দল (টিম) গঠন করতে পারত। ওই দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমাদের কৌশল নির্ধারণ করা হলে সেটি বেশি কার্যকর হতে পারত। কিন্তু আমরা দেখেছি অল্প কয়েকজন লোক কাজটি করেছেন। তাতে শেষমেশ দেখা যাচ্ছে, আদতে কোনো লাভ হয়নি।

ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আমাদের জন্য উদ্বেগের। কারণ, আমাদের মূল প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নামাতে পেরেছে, যা আমাদের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। এতে আমাদের তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। বিদেশি ক্রেতারা এই বাড়তি শুল্কের ভার কতটা নিতে চাইবে, তা বলা যায় না। ধারণা করছি, এটা তারা আমাদের রপ্তানিকারকদের ঘাড়ে দিতে চাইবে। কিন্তু এত বড় শুল্ক ব্যবধান নিয়ে প্রতিযোগীসক্ষম থাকা খুবই কঠিন।

সব মিলিয়ে বলা যায়, নতুন পাল্টা শুল্কে আমাদের জন্য খুব বড় একটা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে স্বল্প মেয়াদে আমরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাতে পারি। আর এই শুল্ক অব্যাহত থাকলে মধ্য মেয়াদে আমাদের পণ্যের ক্রেতারা অন্যত্র চলে যেতে পারে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বড় একটি আমদানিকারক দেশ। সুতরাং তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। ১ আগস্ট থেকে নতুন পাল্টা শুল্ক কার্যকর করার ঘোষণা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তাই পরবর্তী তিন সপ্তাহে আমরা তাদের আরও কী দিতে পারি, তা দেখতে হবে।

বাণিজ্য আলোচনার মধ্যে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ও রয়েছে। আমরা তো আর সেগুলো জানতে পারছি না। এখন বাংলাদেশ কতটুকু দিতে পারবে, সেটি দেখতে হবে। কারণ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধও রয়েছে। সে দিক দিয়ে আমাদের পক্ষে হয়তো অনেক কিছু সম্ভব হবে না। ফলে এ বিষয়গুলো বিচার-বিবেচনা করেই আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।

শুল্ক কমানোর বিষয়ে আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। শুল্ক অন্ততপক্ষে ভিয়েতনামের সমপরিমাণও যদি নামাতে পারি, তাহলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দিক থেকে আমরা মোটামুটিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় থাকতে পারব। কিন্তু ৩৫ শতাংশ শুল্ক অব্যাহত থাকলে আমাদের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বোধ হয় কঠিন হয়ে যাবে বা সম্ভব হবে না।