বর্তমানে ব্যাংক খাতে আমানতে সুদের হার কম থাকার কারণে অনেকে ব্যাংকে টাকা না রেখে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন বা সঞ্চয়পত্র কিনছেন।
Published in Jugantor on Sunday, 13 September 2015.
ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিচ্ছেন গ্রাহক
গোলাম মওলা
ব্যাংক খাতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গ্রাহকরা ১২ হাজার কোটি টাকা কম সঞ্চয় করেছেন। একইভাবে চলতি অর্থবছরেও ব্যাংকে সঞ্চয়ের হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট আমানত সংগ্রহ করা হয়েছিল ৮৭ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ৭৫ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। এক বছরে আমানত কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক আমানতে সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে ব্যাংক থেকে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্যত্র বিনিয়োগ করছেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। আবার অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। এর ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ৫০৯ কোটি টাকা বেশি। গত ২৩ মে সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানো হয়েছে, তবে তা ব্যাংকের তুলনায় এখনও অনেক বেশি রয়েছে। গত জুনে ব্যাংকগুলো গড়ে ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ সুদে আমানত নিয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকে মেয়াদি আমানতে সুদ পাওয়া যাচ্ছে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। আর সঞ্চয়পত্রে সুদ পাওয়া যাচ্ছে ১১ শতাংশেরও বেশি। এতে সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, মানুষ যখন তার প্রয়োজনীয় ব্যয় মিটিয়ে হাতে উদ্বৃত্ত থাকে তখন সে সঞ্চয় করে। আবার আয়ের তুলনায় যখন ব্যয় বেড়ে যায় তখন সঞ্চয় ভেঙে খায়। তিনি উল্লেখ করেন, সাধারণ মানুষের পকেটের টাকা কমে যাওয়ার কারণে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করতে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। তবে অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। তিনি বলেন, দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি না থাকায় ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পাহাড় জমে গেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েই আমানতে সুদ হার কমিয়েছে। এর ফলে অনেকে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিয়ে অন্যত্র বিনিয়োগ করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গেল অর্থবছরে মেয়াদি ও তলবি আমানত দুটিই আগের বছরের চেয়ে কমে গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের বছরে মেয়াদি আমানত এসেছিল ৭৯ হাজার ৭৬ কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ৯০ শতাংশ। গত বছর মেয়াদি আমানত কমে হয়েছে ৬৭ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। একইভাবে মেয়াদি আমানতের পাশাপাশি চলতি আমানতও আগের বছরের চেয়ে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের চলতি আমানত ছিল ৮ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা, গেল অর্থবছরে সাড়ে ৫শ কোটি টাকা কমে নেমেছে ৮ হাজার ১৩৬ কোটি টাকায়। আগের বছরের চেয়ে চলতি আমানত কমেছে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মুনসুর যুগান্তরকে বলেন, এভাবে ব্যাংকের আমানত কমে যাওয়াতে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে। তিনি বলেন, ব্যাংক টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করতে না পারলে যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি আমানত সংগ্রহ করতে না পারলেও ব্যাংকের ক্ষতি হয়।
এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে আমানতে সুদের হার কম থাকার কারণে অনেকে ব্যাংকে টাকা না রেখে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন বা সঞ্চয়পত্র কিনছেন। এর ফলে ব্যাংকের আমানত কমে যাচ্ছে।
এদিকে সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, গত এক বছরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় বেড়েছে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশের বেশি। অথচ আয় বেড়েছে ৬ থেকে ৮ শতাংশ। তবে সম্প্রতি সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়িয়েছে সরকার। এ ছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। ইতিমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে নিত্যপণ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে। জরিপের তথ্যানুযায়ী, নিত্যপণ্য, বাড়িভাড়া, যাতায়াত ভাড়া, চিকিৎসাসেবা, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই খরচ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। আর এই অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা তাদের সঞ্চয় ভেঙে চলছেন।
সম্প্রতি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এর আগে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের ১৫টি পাইকারি ও খুচরা বাজার থেকে বিভিন্ন পণ্য ও সেবামূল্যের ওপর জরিপ করেছে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ক্যাব)।
সংস্থাটির জরিপে দেখা গেছে, গত এক বছরে পণ্য ও সেবা খাতে ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। বাড়িভাড়া বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। সর্বোপরি ২০১৪ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০১৩ সাল জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ১১ শতাংশ। ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে চালের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৪৫, শাকসবজির ৩ দশমিক ২৫, মুরগির ৬ দশমিক শূন্য ৫, গুঁড়ো দুধের ১০ দশমিক ১৮, তরল দুধের ৫ দশমিক ৭১, মাছের ৩ দশমিক ৬০, সাবানের ৩, পান-সুপারির ৩ দশমিক শূন্য ১ এবং ডালের ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এক বছরে দেশী থান কাপড়ের দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৯৬, শাড়িতে ৩ দশমিক ৮৪ এবং গেঞ্জি, তোয়ালে ও গামছায় ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
এদিকে বাজারে এখনও উত্তাপ বইছে। ঊর্ধ্বমুখী পণ্যের মূল্যে নাভিশ্বাস হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নিু ও মধ্য আয়ের মানুষ পণ্যের বাজারে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলেছে আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে।