সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ পরিচালিত ‘জুট অ্যান্ড বাংলাদেশ ইকোনমি’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে বার্ষিক পাটের ব্যাগের চাহিদা ৯০ হাজার পিস থেকে বেড়ে ৮৪ কোটি পিসে উন্নীত হবে।
Published in Ittefaq on Tuesday, 13 October 2015.
সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে সরকারি পাটকল
ফাইলবন্দী হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প
মুন্না রায়হান
সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে সরকারি পাটকল
লোকসানের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে সরকারের সংস্থা বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। টানা ২২ বছর লোকসানের পর ২০১০-১১ অর্থবছরে সংস্থাটি লাভের মুখ দেখলেও আবারও পিছু নিয়েছে লোকসান। ফলে সোনালী আঁশ পুনর্জাগরণের যে স্বপ্ন দেখেছিল কৃষকসহ এ খাত সংশ্লিষ্টরা তা যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার বন্ধ পাটকল চালু করতে নজর দিলেও তা সংস্কার ও আধুনিকায়নে গুরুত্ব দেয়নি। বহু বছরের পুরোনো যন্ত্রাংশ দিয়ে চলছে পাটকলগুলো। ফলে আশানুরূপ উত্পাদন হচ্ছে না। বর্তমানে বিজেএমসি’র ২৩টি পাটকলে দৈনিক ৬৮০ টন পাটপণ্য উত্পাদিত হয়। অথচ আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হলে উত্পাদন ৯শ’ টনে উন্নীত হবে।
এছাড়া পাট পণ্যের বহুমুখীকরণ ও বিশ্বে নতুন বাজার ধরতে পারেনি সরকার। শুধু তাই নয়, পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন করলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ পরিচালিত ‘জুট অ্যান্ড বাংলাদেশ ইকোনমি’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে বার্ষিক পাটের ব্যাগের চাহিদা ৯০ হাজার পিস থেকে বেড়ে ৮৪ কোটি পিসে উন্নীত হবে। এছাড়া ধান, চাল, সার ও চিনি-তে পাটের মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত করলে বছরে ৫০ থেকে ৫৫ কোটি পাটের বস্তা প্রয়োজন হবে।
বর্তমানে বিজেএমসি দেশে উত্পাদিত পাটের ১৬ শতাংশ ক্রয় করে। এই হিসাবে প্রায় ২০ লাখ বেল পাট ক্রয় করা হয়। পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন পুরোপুরি কার্যকর হলে পাট ক্রয়ের পরিমাণ আরো বাড়বে।
বিজেএমসি সূত্র জানায়, সরকারের এই সংস্থাটির লোকসানের আরেক কারণ, তাদের মাথায় অতিরিক্ত শ্রমিকের বোঝা চেপে আছে। বিজেএমসিতে বর্তমানে ৩৩ হাজার স্থায়ী, ২৭ হাজার বদলি ও ৬ হাজার আউটসোর্সিং শ্রমিক রয়েছে। এরমধ্যে ২২ হাজার শ্রমিকেরই কোন কাজ নেই। তাদের বেতন দিতে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বেশি লাগে। এছাড়া পুরনো যন্ত্রপাতির কারণে পণ্যের উত্পাদন খরচ বেশি পড়ে।
সূত্র আরো জানায়, প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে পাট কিনতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় পরে বেশি দরে পাট কেনায় বড় অংকের আর্থিক ক্ষতি হয় বিজেএমসির। এরসাথে যোগ হয়েছে পাটের আন্তর্জাতিক মন্দা বাজার। রাজনৈতিক সংকটসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের পাটের বড় ক্রেতা সিরিয়া, মিসর, ইরান, ইরাক ও লিবিয়া পাট ও পাটজাত পণ্যের আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। এরমধ্যে অনেক জায়গায় বাজার পুরোপুরি বন্ধ। সম্প্রতি সরকারি পাটকলগুলোর লোকসানের কারণ চিহ্নিত করে বস্ত্র ও পাট এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে বিজেএমসির দেয়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা রয়েছে।
বাড়ছে লোকসান :টানা ২২ বছর পর গত ২০১০-১১ অর্থবছরে লাভের মুখ দেখে বিজেএমসি। এই অর্থবছরে সংস্থাটির লাভ হয় ১৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কিন্তু এরপর আবার ধারাবাহিকভাবে লোকসান দিচ্ছে বিজেএমসি। ২০১১-১২ অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান দেয় ৬৬ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৮০ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৯৬ কোটি ৭৫ লাখ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লোকসানের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৬৩৯ কোটি টাকা। এভাবে প্রতি বছরই বাড়ছে লোকসানের অংক। আর এর প্রভাব পড়ছে পাটচাষী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উপর। সরকারি পাটকলগুলোতে পাট সরবরাহ করে তারা বিল পাচ্ছে না। বিল বাবদ তাদের প্রায় ১০০ কোটি টাকা পাওনা বলে জানা গেছে।
বাস্তবায়িত হয়নি পাট কমিশনের সুপারিশ:দেশে এবং বিশ্ব পর্যায়ে পাটের ব্যবহারের প্রসারমান সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পাট খাতকে পুনর্গঠন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে বলে ২০১১ সালে প্রতিবেদন দিয়েছিল পাট কমিশন। প্রতিবেদনে সরকারি জুট মিলগুলোতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য বিজেএমসিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া জুটমিলগুলোর ব্যবস্থাপনা ও বিপণন প্রক্রিয়ার দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পুরনো অব্যবহারযোগ্য মেশিনারী বদলে নতুন মেশিনারী স্থাপন করার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে। কিন্তু অধিকাংশ সুপারিশই বাস্তবায়ন হয়নি।
কমিশনের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ইত্তেফাককে বলেন, কমিশন পাট খাতের পুনর্জাগরণে কি করতে হবে প্রতিবেদনে তাই তুলে ধরেছিল। কিন্তু প্রতিবেদন দেয়ার পর সে বিষয়ে আর খোঁজ নেয়া হয়নি। তবে প্রতিবেদনে উল্লেখিত সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে পাটখাতের সুদিন ফিরে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
ফাইলবন্দি উন্নয়ন প্রকল্প: সূত্র জানায়, সরকারি পাটকলগুলোর উন্নয়নে ২০১১ সালে বিজেএমসি এক হাজার ৮৪ কোটি টাকার একটি সম্মিলিত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। এতে পাটকলগুলোর যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন, অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শ্রমিকের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্পটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য এর ফাইল সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
সরকারি পাটকলগুলোর লোকসানের বিষয়টি স্বীকার করে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের পাটকলগুলো ৬০/৭০ দশকের। অনেক পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে চলছে এসব পাটকল। ফলে তাদের উত্পাদন ক্ষমতাও কম। এগুলো আধুনিকায়ন করতে হবে। ইতিমধ্যে ঢাকা ও খুলনার দুটি পাটকল আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারি পাটকলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি শ্রমিক রয়েছে। তাদের মজুরিও বেসরকারি মিলগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ফলে তাদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতি বছর সরকারি মিলগুলোকে অনেক টাকা গুণতে হয়। এছাড়া পাট কেনার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে বরাদ্দ না পাওয়ায় পরে অনেক বেশি টাকা দিয়ে কিনতে হয়। এসব কারণেও লোকসান বাড়ছে। সেইসাথে বিভিন্ন কারণে বিশ্বে পাটের বাজার কিছুটা সংকুচিত হয়েছে। তবে আমরা দেশের ভিতরেই পাটের ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছি। পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা হলে পাটের সোনালী দিন আবার ফিরে আসবে।