সপ্তম পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলো অর্জন না হওয়ার পেছনে বিশ্বপরিস্থিতি অনেকটা দায়ী।
Published in Bonik Barta on Monday, 19 October 2015.
আগামীকাল এনইসিতে উঠছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা
মাসুম বিল্লাহ
ভিশন-২০২১ অর্জনের লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনার বেশকিছু লক্ষ্য এখনো অনর্জিত। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ধরা হয়েছিল, তা অর্জন হয়নি। অধরা রয়ে গেছে বিনিয়োগ ও রফতানির লক্ষ্যও। এমন পরিস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আসছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এ পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। সেই সঙ্গে জোরদার করতে হবে সংস্কার কার্যক্রম।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে চূড়ান্ত করা হয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া। আগামীকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে পাঁচ বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনা। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও এনইসি চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। প্রস্তুতি হিসেবে এরই মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক সেরে নিয়েছে এ বিষয়ে গঠিত স্টিয়ারিং কমিটি।
নতুন এ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা হচ্ছে পূর্ববর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সফলতা-ব্যর্থতার দিকগুলো; যার ওপর ভিত্তি করে এগোবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনের যাত্রা। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১০-১১ থেকে ২০১২-১৩ সময়ে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৬ দশমিক ৩। ২০১৪-১৫ অর্থবছর নাগাদ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৮ শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জন হয়েছে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। ফলে ২০২১ সাল নাগাদ ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় যে লক্ষ্য ধরা হয়েছিল, তা কমিয়ে ৮ শতাংশে আনা হয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার চূড়ান্ত খসড়ায়।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির মতো বিনিয়োগের লক্ষ্যও অর্জন হয়নি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। ওই পাঁচ বছরের মধ্যে কেবল একটি মাত্র অর্থবছরে (২০১০-১১) বিনিয়োগ লক্ষ্য অর্জন হয়েছে। ওই অর্থবছর জিডিপির ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ বিনিয়োগ লাভের লক্ষ্যের বিপরীতে অর্জন হয়েছে ২৫ দশমিক ১ শতাংশ। তবে পরের অর্থবছর ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যের বিপরীতে অর্জন ২৬ দশমিক ৬। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ লক্ষ্যের বিপরীতে অর্জন ২৬ দশমিক ৮। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিনিয়োগ এসেছে জিডিপির ২৭ দশমিক ২ শতাংশ; যা লক্ষ্যের চেয়ে কম। এমন পরিস্থিতিতে ২০২০ সাল নাগাদ বিনিয়োগ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে জিডিপির ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ; যা প্রেক্ষিত (২০১০-২১) পরিকল্পনার লক্ষ্যের চেয়ে কম।
একই অবস্থা রফতানি লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রেও। ২০১০-১১ অর্থবছরে এ লক্ষ্য অর্জন হলেও পরের দুই অর্থবছর তা হয়নি। ২০১০-১১ অর্থবছর জিডিপির ২০ দশমিক ৩ শতাংশ রফতানি লক্ষ্যের বিপরীতে অর্জন ছিল ২০ দশমিক ৬ শতাংশ। পরের দুই অর্থবছর বিনিয়োগ জিডিপির ২১ দশমিক ১ শতাংশের বিপরীতে ২১ ও ২২ দশমিক ১ শতাংশের বিপরীতে ২০ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন হয়।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জন না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বিনিয়োগ লক্ষ্য অর্জন না হওয়ার অন্যতম কারণ অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার না হওয়া। তাছাড়া এখানে বাণিজ্য খরচ (কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস) অনেক বেশি। একই সঙ্গে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় প্রয়োজনীয় হলেও এক্ষেত্রে সেটার বেশ ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বেশকিছু লক্ষ্য অনর্জিত রয়ে গেছে। সপ্তম পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হলে এসব বাধা দূর করতে হবে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৫ সালের মধ্যে ১ কোটি ৪ লাখ কর্মসংস্থানের লক্ষ্য ছিল। এ লক্ষ্য থেকেও কিছুটা পিছিয়ে আছে সরকার। এছাড়া ২০১৫ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার সাড়ে ২২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যও অর্জন হয়নি। বর্তমানে দারিদ্র্য ২৪ শতাংশের কিছুটা বেশি।
সপ্তম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৩১ লাখ ৯০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। এর বেশির ভাগই আসবে বেসরকারি খাত থেকে। পরিকল্পনায় কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা আরো কমানো এবং নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের আশা করছে সরকার। এ লক্ষ্যে দারিদ্র্য কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নামিয়ে আনা, ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বৃত্ত ভেঙে আগামী পাঁচ বছরে ৮ শতাংশে উত্তরণ, কৃষি থেকে শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে প্রবেশ, ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং মূল্যস্ফীতি নাগালের মধ্যে রাখার লক্ষ্য নেয়া হয়েছে।
এদিকে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গত পাঁচ বছরে ব্যয়ের যা লক্ষ্য ছিল, তার চেয়ে আগামী পাঁচ বছরে ব্যয় হবে দ্বিগুণেরও বেশি। এ ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ২৮ লাখ ৪৫ হাজার ১০০ কোটি এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ৩ লাখ ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম বলেন, পরিকল্পনার বছর শেষে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এ ধরনের ব্যয়ই প্রয়োজন হবে। কারণ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর হতে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, যোগাযোগ খাতে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ, আইসিটি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা সংক্রান্ত সেবা রফতানিতে সুনির্দিষ্ট নীতিকৌশল প্রণয়নসহ ছয়টি বিষয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
নতুন পরিকল্পনার খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশকি ২, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ শতাংশ। এ লক্ষ্যে অর্জনে শিল্প (ম্যানুফ্যাকচারিং) খাতে গড় প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। আর সেবা খাতে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং শিল্প, সেবা ও কৃষি খাত মিলে গড়ে ৭ শতাংশের উপরে।
পরিকল্পনায় মূল্যস্ফীতি বর্তমানের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০২০ সালে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। মোট বিনিয়োগ বর্তমানে জিডিপির ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ হলেও আগামী পাঁচ বছরে তা জিডিপির ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। জাতীয় সঞ্চয় বর্তমানে জিডিপির ২৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ২০২০ সালে জিডিপির ৩২ দশমিক ১ শতাংশে নিয়ে যাওয়া এবং আগামী পাঁচ বছরে দেশী-বিদেশী মিলে নতুন ১ কোটি ৩২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সপ্তম পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলো অর্জন না হওয়ার পেছনে বিশ্বপরিস্থিতি অনেকটা দায়ী। পরিকল্পনাটা নেয়া হয় পাঁচ বছরের জন্য। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে বিশ্বের অনেক কিছু পরিবর্তন হয়, যা সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেকটাই প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। তবে এর বাইরেও বিনিয়োগের গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে বেসরকারি খাত বিনিয়োগে এগিয়ে আসেনি। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিও পিছিয়ে গেছে। কারণ বিনিয়োগের বেশির ভাগই বেসরকারি খাতের। সরকারের বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে বেসরকারি খাত আশানুরূপভাবে এগিয়ে আসেনি। ফলে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জন কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছে। তবে সপ্তম পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা দূর করতে হবে।
এদিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অগ্রাধিকারের খাতের মধ্যে রয়েছে— কারিগরি ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ গঠন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন, জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ, আইসিটি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা সংক্রান্ত সেবা রফতানিতে সুনির্দিষ্ট নীতিকৌশল প্রণয়ন, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগে গতিশীলতা আনা ও রফতানির গতিশীলতা আনতে পণ্যে বৈচিত্র্য আনা।
এছাড়া সুশাসনেও বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে সুশাসন নিশ্চিত করতে বিচার ও আইনের শাসন, সরকারি প্রশাসনে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সুশাসন উন্নীত করার বিভিন্ন কৌশল হাতে নেয়া হয়েছে। এজন্য যেসব কৌশল নেয়া হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে— বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে সহজ এবং স্বচ্ছ মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা।