Published in বণিক বার্তা on Monday, 1 February 2016
দরিদ্রের অর্থনীতিবিদ
ড. ফাহমিদা খাতুন
বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান কৃষকের কঠোর পরিশ্রম এবং তার পাশাপাশি সরকারের কার্যকরি নীতিসহায়তা। তবে দেশের দরিদ্রতম মানুষের মধ্যে এ অর্জন সমানভাবে বণ্টন না হওয়া পর্যন্ত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা খাদ্যনিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয় না। খাদ্যনিরাপত্তা এ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এশিয়ার বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন এ অধিকারে বিশ্বাস করতেন। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য এ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করাই ছিল তার লক্ষ্য। এ কথা বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি নিয়ে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। এ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পুরো জীবন উত্সর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝতে, ব্যাখ্যা করতে এবং অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে।
১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) গবেষণা সহযোগী হিসেবে যোগ দেয়ার সময় থেকে ড. মাহবুব হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি তখন বিআইডিএসের মহাপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে শিক্ষকদের কাছ থেকে আমি তার কথা শুনেছি। শিক্ষকরা ক্ষুদ্র ঋণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিষয়ে ড. মাহবুব হোসেনের গবেষণাকর্ম পড়ার উপদেশ দিতেন। এ কারণে বিআইডিএসে তার সঙ্গে কাজ করা আমার জন্য একটি বিশাল সুযোগ ছিল। ১৯৯১ সালে উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশে আমি লন্ডনে যাই এবং ১৯৯৬ সালে আবার বিআইডিএসে যোগ দিই। এরই মধ্যে মাহবুব ভাই বিআইডিএস ছেড়ে ফিলিপাইনে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ইরি) যোগ দিতে চলে যান। তিনি ইরিতে অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে ১৫ বছরের বেশি সময় কাজ করেছিলেন।
কৃষির কাঠামো, মধ্যস্বত্ব প্রথা, গ্রামীণ অকৃষি কার্যক্রম, গ্রামীণ অবকাঠামো, ঋণ, খাদ্যনিরাপত্তা, আয় বণ্টন এবং দরিদ্রদের ওপর প্রযুক্তির প্রভাবের ওপর ড. মাহবুবের কাজ পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও সমাদৃত। ইরির কৌশল ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরিতে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যখন তিনি ফিলিপাইন থেকে ফিরলেন এবং ২০০৭ সালে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেন, তখন থেকে তার সঙ্গে আমার পেশাগত ও সামাজিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য হন, যা আমাদের পেশাগত সম্পর্ককে আরো মজবুত করে।
তিনি শুধু একজন গবেষক ছিলেন না, দক্ষ ও সফল প্রশাসকও ছিলেন। কাজ ও দায়িত্ব গ্রহণের দিক থেকে তিনি তার সহকর্মীদের চেয়ে আলাদা ছিলেন। উচ্চতর দায়িত্ব গ্রহণের পরিক্রমায় তিনি এগিয়ে ছিলেন। তিনি বিআইডিএসের মহাপরিচালক হন, যখন তার বয়স মাত্র চল্লিশের কোটায়। ইরি ও ব্র্যাক উভয় প্রতিষ্ঠানে তার কাজ ছিল গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার মিশেলে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উভয় কাজ সমানভাবে করতেন। ব্র্যাকে থাকাকালে তিনি দারিদ্র্য নিরসন ও নারীর ক্ষমতায়নের কাজে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। তার এ কাজ শুধু বাংলাদেশের জন্য ছিল না, এশিয়া ও আফ্রিকার আরো দশটি দেশেও অনুরূপ কাজ করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা তিনি সফলভাবে ওইসব অঞ্চলে কাজে লাগিয়েছেন।
যখন আমরা অনেকেই অর্থনৈতিক তথ্যের গতিপ্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছি, তখন ড. মাহবুব মাঠে গেছেন ও তথ্যের বাস্তবতা নিজে পরীক্ষা করে দেখেছেন। তিনি মনে করতেন, তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করা ছাড়া প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়। সেজন্য বিআইডিএসে আমার প্রথম গবেষণাকাজ ছিল বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা। এ কাজের জন্য আমি প্রথমবারের মতো ওইসব জেলায় গিয়েছিলাম এবং এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমার জ্ঞানের দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। তার তত্ত্বাবধানে বস্তিবাসীর আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ওপরও কাজ করেছি। এজন্য আমার সহগবেষকরা ও আমি তথ্য সংগ্রহে বিভিন্ন বস্তি পরিদর্শন করেছিলাম। আমার অর্থনৈতিক গবেষণার উত্কর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে এ প্রশিক্ষণ অমূল্য ভূমিকা রেখেছিল।
ড. মাহবুব হোসেন বিভিন্ন দিক থেকে অনন্য ছিলেন। তিনি বিশাল তথ্যভাণ্ডার নিয়ে কাজ করতেন। তিনি এ তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করতেন তার পরিমাণগত ও গুণগত বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও নিজ অনুসন্ধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের মাধ্যমে। প্রাথমিক স্তরের তথ্য ব্যবহারের মনোভাব তাকে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন একজন অর্থনীতিবিদে পরিণত করেছে। তার প্রতিটি বিশ্লেষণ মাঠপর্যায় থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে রচিত। সেটা ধান উত্পাদন নিয়েই হোক বা কৃষিতে বন্যার প্রভাব নিয়েই হোক। তিনি যেকোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন মাঠপর্যায়ে থেকে পাওয়া নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। এজন্য তার সঙ্গে ওইসব বিষয়ে কথা বলা ছিল অনেকের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্যই তিনি যে নীতি ব্যবস্থাপত্র তৈরি করতেন, তা ছিল বাস্তবসন্মত ও কার্যকরি।
ড. মাহবুব ছিলেন একজন অত্যন্ত পরিশ্রমী, নিবেদিতপ্রাণ, নিয়মনিষ্ঠ, বিনয়ী, সত্ ও দয়ালু ব্যক্তি। তার দিন শুরু হতো খুব সকালে। তিনি প্রশাসনিক কাজ শুরু করার আগে ভোরে উঠে গবেষণা প্রতিবেদন লিখতেন।
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ড. মাহবুব হোসেন বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির দেয়া প্রথম স্বর্ণপদক পান তিনি। ২০১৩ সালে রাজনীতি ও অর্থনৈতিক-বিষয়ক আন্তর্জাতিক পত্রিকা ফরেন পলিসির তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ৫০০ ব্যক্তির একজন ছিলেন তিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দেশের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখলেও বাংলাদেশের কোনো সরকার তাকে কোনো পুরস্কার দেয়নি।
তিনি অবশ্য পুরস্কারের জন্য কাজ করেননি। তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থেকেছেন। তিনি পরামর্শদাতা ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে জড়িত ছিলেন বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি সংস্থা, বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ও আন্তর্জাতিক সংস্থায়। এছাড়া তিনি অনেক পিএইচডি ও মাস্টার্স ছাত্রকে তত্ত্বাবধান করেছেন, যাদের মধ্যে অনেকে আজ নিজ নিজ পেশায় সফল।
লেখক: সিপিডির গবেষণা পরিচালক