Professor Mustafizur Rahman on export earning target by 2021

Published in কালের কন্ঠ on Friday, 19 February 2016

 

প্রধান কিছু পণ্যে নির্ভর রপ্তানি বাজার

এম সায়েম টিপু

export earning target by 2021দেশের রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়াতে সরকারের নানা পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও এসব পরিকল্পনা এখনো কাগজে-কলমেই বিদ্যমান। ফলে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য এখনো প্রধান কিছু পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্লেষকরা বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে সরকার রপ্তানি খাত থেকে ৬০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা পূরণ করতে হলে প্রচলিত পণ্য ও বাজারের পাশাপাশি নতুন পণ্য ও নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি আয় আরো বাড়ানোরও উদ্যোগ নিতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, ৬০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পণ্যে বৈচিত্র্যকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ ও উত্পাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চামড়া, জুতা ও ওষুধ খাতেও রপ্তানি বাড়াতে আরো জোর দিতে হবে। বিশেষ করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবির নতুন পণ্য ও নতুন বাজার তৈরির পরিকল্পনা আরো গতিশীল করতে হবে।

এই প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পণ্যে বৈচিত্র্যকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ এবং উত্পাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে ইউরোপ এবং আমেরিকা থেকে। যদিও সম্প্রতি জাপান, তুরস্ক ও ভারতসহ কিছু নতুন বাজার তৈরি হয়েছে। এসব দেশে যা রপ্তানি আয় হয় এর অধিকাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। এ ক্ষেত্রে শুধু পোশাকের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে চামড়া, ফুটওয়্যার ও ওষুধ খাতেও রপ্তানি বাড়াতে জোর দিতে হবে। এ ছাড়া চিংড়ি, পরিবেশবান্ধব পাট পণ্য ও প্লাস্টিকের ওপরও জোর দেওয়া যেতে পারে।’ নতুন বাজার হিসেবে রাশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার প্রতি জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘নতুন বাজারগুলোতে ব্যাংকিং চ্যানেল আরো সহজ করা যেতে পারে। যেসব পণ্য উত্পাদনে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করে সেসব পণ্য আবার বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে।’

এদিকে ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) বাংলাদেশ রপ্তানি খাত থেকে আয় করে ৩১ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরে এ খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে সাড়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলার। তথ্যে দেখা যায়, গত বছর তৈরি পোশাক খাত থেকেই আয় হয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা মোট আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ। এ ছাড়া রপ্তানি আয়ের অন্য চার শীর্ষ খাত হচ্ছে চামড়া (১ বিলিয়ন ডলার), প্রাইমারি কমোডিটি (১ বিলিয়ন ডলার), পাট ও পাট পণ্য ৯০০ মিলিয়ন এবং কৃষি পণ্য (৬০০ মিলিয়ন ডলার)।

এ বিষয়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন সময় এসেছে পণ্যের বহুমুখীকরণ ও নতুন বাজার সৃষ্টিতে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার। কেননা দীর্ঘদিন একটি বা দুটি পণ্যের বাজার থাকে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রেতারও পছন্দের পরিবর্তন হচ্ছে। সে জন্য আমাদের নতুন পণ্য তৈরি করতে হবে। আর নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য সরকারকে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’

ইপিবির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার ‘এক জেলা এক পণ্য’ নীতি বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে। আমরা সরকারের এই নীতির আলোকে কাজ শুরু করে দিয়েছি। ইতিমধ্যে তিনটি জেলায় তিন পণ্য নির্ধারণ ও সে অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন চলছে। যেমন দিনাজপুর জেলার পাপাডাম (পাঁপড়ভাজা), সিলেটে আগর কাঠ এবং বান্দরবানে রাবার নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য জেলায়ও সহসাই আমরা কাজ শুরু করব। এ ছাড়া নতুন বাজার তৈরিতেও আমরা কাজ করছি।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত কয়েক বছর ধরেই অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি আয় বাড়ছে না। অপ্রচলিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে মানুষের মাথার চুল, জাহাজ, সিমেন্ট, সিল্ক, প্লাস্টিক ওয়েস্টেজ, রাবার, হ্যান্ডিক্র্যাফট, টেরিটাওয়েল, মাথার ক্যাপ, কপার ওয়্যার, গলফ স্যাফটের মতো বেশ কিছু পণ্য। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্লাস্টিক ওয়েস্টেজ রপ্তানি কমে আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ। এ ছাড়া সিল্কে টেরিটাওয়েলে ১৮ শতাংশ, বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালসে ৯৬ শতাংশ, সমুদ্রগামী জাহাজে ৯২ শতাংশ, কপার ওয়্যারে ২৫ শতাংশ, বাইসাইকেলে ২০ শতাংশ, গলফ স্যাফটে ২৪ শতাংশ কমেছে। এর পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও একই ধারা অব্যাহত ছিল। এরপর চলতি বছরের সাত মাসেও (জুলাই-জানুয়ারি) এ ধরনের অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছর অপ্রচলিত পণ্যের মধ্যে কাট ফ্লাওয়ার রপ্তানি কমেছে ৩৫ শতাংশ, প্লাস্টিক ওয়েস্টেজ ৩৩ শতাংশ, সিমেন্টে ৫৯ শতাংশ, কসমেটিকসে ৪৫ শতাংশ, ছাতার স্টিক ৬২ শতাংশ, গ্লাস ও গ্লাসওয়্যারে ১০ শতাংশ, আয়রন স্টিলে ২৪ শতাংশ, ইলেকট্রিক প্রোডাক্টে ৩১ শতাংশ, বাইসাইকেলে ২৯ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি আয় বছর বছর কমছেই।

অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি না হওয়ার কারণ সম্পর্কে ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি না করতে পারাই এর প্রধান কারণ। কেননা প্রচলিত বাজারে তৈরি পোশাকসহ আমাদের প্রচলিত পণ্যই বেশি চলে। নতুন বাজার সৃষ্টি করা গেলে সেসব স্থানে আমাদের নতুন পণ্য ও অপ্রচলিত পণ্য বিক্রি বাড়বে। অবশ্য এ জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের যে বাণিজ্য মিশন ও বাণিজ্য উইং রয়েছে সেগুলোকে গতিশীল করতে হবে এবং ওই স্থানে যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন তাঁদের আরো দক্ষ হতে হবে।’

ইপিবি কর্মকর্তারা জানান, প্র্রাথমিকভাবে ৪১ জেলায় ১৪ পণ্য উত্পাদনের জন্য জোর দেওয়া হয়েছে। এসব পণ্য রপ্তানি করা হবে। এ ১৪ পণ্যের মধ্যে আগর উড ও আগর আতর উত্পাদন হবে মৌলভীবাজার, খুলনায় কাঁকড়া, নাটোরে ভেষজ উদ্ভিদ। দিনাজপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ায় উত্পাদন হবে সরু ও সুগন্ধি চাল, পঞ্চগড়ে অর্গানিক চা, বান্দরবানে রাবার। সুনামগঞ্জ, ফেনী, ফরিদপুর, জামালপুর, রংপুর ও কুড়িগ্রামে হস্তশিল্প। রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও রাঙামাটিতে হস্তচালিত তাঁতশিল্প ইত্যাদি।