Published in সকালের খবর on Monday, 30 May 2016
বড় প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতাই চ্যালেঞ্জ
মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন
দেশের রেল, সড়ক ও বন্দর এবং বিদ্যুত্ অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তবে সরকার এ খাতে বরাদ্দ বাড়ালেও তা যথেষ্ট নয় বলছেন অর্থনীতিবিদরা। আবার সক্ষমতার অভাবে ওই বরাদ্দ ব্যয় এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ ব্যয় নিয়ে সংশয় রয়েই যাচ্ছে।
পরিকল্পনা বিভাগের সচিব তারিক-উল-ইসলাম বলেছেন, আগামী অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বড় প্রকল্পে চাহিদামতোই পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ছোট ছোট অনেক প্রকল্পে কম বরাদ্দ দিয়ে বড় প্রকল্পকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বরাদ্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। ব্যবহার করতে না পারায় প্রতি অর্থবছরই বরাদ্দ সংশোধন করা হয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্প : সরকার আগামী অর্থবছরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চাচ্ছে। এজন্য সেতু বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। নতুন অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৬ হাজার ২৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তবে এডিপিতে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত কতটুকু অর্থ ব্যয় করা সম্ভব সেটাই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্থ ব্যয় করতে না পারায় সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) বরাদ্দ কমিয়ে ৫ হাজার ৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা করা হয়েছে। তাই আগামী অর্থবছরেও বরাদ্দের পুরো অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়ে যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প : নতুন অনুমোদন পাওয়া এই প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ১০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা আর চীনের অর্থায়ন থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। অথচ এখনও পর্যন্ত চীনের সঙ্গে ঋণ চুক্তিই হয়নি। কবে চুক্তি হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। অর্থাত্ এ প্রকল্পের শুরুতেই বিপত্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কর্ণফুলী তলদেশে টানেল প্রকল্প : ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়। আগামী অর্থবছরে এই প্রকল্পে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৮১ কোটি। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৯৫৭ কোটি এবং চীনের ঋণ থেকে ১ হাজার ২৪ কোটি টাকা ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি একটি অনুদান চুক্তি সই হলেও ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে চীনের সঙ্গে কোনো ঋণ চুক্তি হয়নি। এ অবস্থায় বরাদ্দ দেওয়া হলেও অর্থ ব্যবহার নিয়ে সংশয় আছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রকল্প : দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজারের ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়েল গেজ নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। কিন্তু সম্প্রতি প্রকল্পটি নতুন করে সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধনের পর সরকারি তহবিল থেকে এ প্রকল্পে আগামী বছর বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৩১ কোটি টাকা।
মেট্রোরেল : ঢাকার বহু প্রত্যাশিত মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য স্থাপনা নির্মাণের আগে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। আগামী অর্থবছরই প্রথম পর্যায়ের লাইন স্থাপনের দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে জানা গেছে। ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের ডিটেইলড ডিজাইনের কাজও শেষ হবে। রুট চূড়ান্ত করতে মূল জরিপ ও পুনঃজরিপ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। মাটির মান পরীক্ষায় কিছু জরিপও প্রায় চূড়ান্ত। আগামী অর্থবছরে এ প্রকল্পে মোট বরাদ্দ থাকবে ২ হাজার ২২৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বৈদেশিক সহায়তা থেকে জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়ন থেকে বরাদ্দ থাকছে ১ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুেকন্দ্র : রূপপুর বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০১৭ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মার্চ পর্যন্ত এ প্রকল্পে মোট ৫ হাজার ৮৭ কোটি টাকার বরাদ্দের মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। মোট ব্যয়ের চার হাজার কোটি টাকাই জোগান দেওয়া হচ্ছে রাশিয়ার ঋণ থেকে। আগামী অর্থবছরে এ প্রকল্পে ৬১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বৈদেশিক সহায়তা থেকে বরাদ্দ আছে ৩১০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
অবশ্য অর্থনীতিবিদরা এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের এ বরাদ্দ যথেষ্ট নয় বলে দাবি করছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক নাজনিন আহমেদ বলেন, যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে না বলেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে না। কারণ বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে অবকাঠামোর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০। যেখানে চীনের ৪৬, থাইল্যান্ডের ৪৮, শ্রীলঙ্কার ৭৫, ভারতের ৮৭ ও কম্বোডিয়ার অবস্থান হচ্ছে ১০৭। তাই অবকাঠামোর উন্নয়নেই মনোনিবেশ করতে হবে। এডিপিতে গত চার বছরে পরিবহন খাতে সর্বোচ্চ ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা যথেষ্ট নয়। বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সড়ক বিভাগ, রেলপথ, নদীপথ, নতুন করে সমুদ্রবন্দরের উন্নয়ন, গভীর সমুদ্র পথের উন্নয়ন, ঢাকা পরিবহন সিস্টেমের উন্নয়নে ২০২০-২১ সালের মধ্যে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৪২ কোটি টাকার বিনিয়োগ করতে হবে। যা প্রতিবছরে গড়ে হচ্ছে ১০ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, আমাদের অর্থনীতির ৫০ শতাংশ বিশেষ করে আমদানি-রফতানি বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত। তাই দক্ষতা বাড়াতে হবে। তা নাহলে পিছিয়ে পড়বে দেশ। এ ক্ষেত্রে অবকাঠামোর সমস্যা তো আছেই। তবে এটাই বড় সমস্যা নয়। দুর্নীতি, সুশাসন, প্রকল্প ব্যয় ও বাস্তবায়নও বড় ব্যাপার। আমাদের দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের হার অত্যন্ত কম। তাই ব্যয়ও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আবার গুড গভর্ন্যান্স ও জবাবহিদিতার অভাবে দেশি অর্থায়নের প্রতি ঝোঁক বেশি বলে তিনি উল্লেখ করেন।