Published in মানবকণ্ঠ on Sunday, 26 June 2016
ইইউ-যুক্তরাজ্য বিচ্ছেদ
ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য
আসাদ জোবায়ের ও রবিউল হক
ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার (ব্রেক্সিট) সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। ব্রিটেনের এ সিদ্ধান্তের কারণে সেখানে অনেক কিছুই পরিবর্তন আসবে এবং এই পরিবর্তনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন আনতে হবে বাংলাদেশকেও। এছাড়া ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্তে অর্থনেতিক দিক দিয়ে ইতিমধ্যে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, তাতে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের ওপর। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে সেদেশে পণ্য রফতানিতে ভাটা পড়তে পারে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে কমে যেতে পারে বৈদেশিক সাহায্য ও বিনিয়োগ।
বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক গভীর। দেশটিতে পাঁচ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি বসবাস করে আসছেন। যারা দেশটির মূলস্রোতে মিশে গিয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছেন। বাংলাদেশি পণ্য রফতানির বৃহৎ বাজারের একটি হলো ইউরোপ। আর ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহৎ বাজার এই যুক্তরাজ্য। প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের পণ্য বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়। এর মধ্যে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশ। বৃহৎ দাতা দেশ হিসেবেও দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের চমত্কার সম্পর্ক রয়েছে। তবে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুরোটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মে পরিচালিত হয়। ফলে ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ায় এ সম্পর্ক নতুন করে গড়তে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়ায় সংকটের প্রথম ধাক্কা অভিবাসীদের ওপরই পড়বে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত হূমায়ন কবীর মানবকণ্ঠকে জানান, ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে তার ধাক্কা প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপরও আসবে। তবে ইইউতে এলডিসি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যে যে সুবিধা পাওয়া যেত, তা নিয়ে নতুন করে সমঝোতা করতে হবে। এজন্য ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়বে না বা নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্কের কোন মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হবে না।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন জানান, ব্রিটেনে যেসব বাংলাদেশি আছেন তারা সবাই সেদেশের নাগরিক। ফলে তাদের ভাগ্য ব্রিটেনের ভাগ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এতে ব্রিটেনের ওপর যে ধাক্কা আসতে শুরু করেছে, তা ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের ওপরও আসবে। কেননা এ ধরনের সংকটের প্রথম ধাক্কা অভিবাসীদের ওপর দিয়েই হয়। তবে কিছুটা ইতিবাচক ফলও আসতে পারে বলে মনে করেন তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত রেস্তোরাঁ শিল্পের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। কারণ ইইউ জোটে থাকার কারণে রেস্তোরাঁ শিল্পে বাংলাদেশ থেকে বাবুর্চি নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর প্রতি ব্রিটেনের একটি অঙ্গীকার ছিল। এ কারণে সেখান থেকে বাবুর্চি নিতে হতো। এ নিয়ে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ শিল্পে ক্ষোভ ছিল। এ কারণে এই শিল্পটি দীর্ঘদিন ধরে লোকবলের সংকটে ভুগেছে। এতে বাংলাদেশিদের এই শিল্পটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশ থেকে লোকবল নিতে পারেনি। এখন ইইউ থেকে আলাদা হয়ে গেলে বাংলাদেশ থেকে লোকবল নেয়া সম্ভব হবে। ফলে রেস্তোরাঁ শিল্প যেমন চাহিদামতো লোকবল পাবে, তেমনি এই শিল্পের গুণগত মানও উন্নত হবে।
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশর সম্পর্কের আরেক সূত্র বাণিজ্য। বিশেষ করে ব্রিটেনসহ গোটা ইউরোপ বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার। ইইউ-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুক্তরাজ্যসহ ২৮টি দেশ বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধার আওতায় বিনা শুল্কে পণ্য রফতানির সুযোগ দিয়ে থাকে। ইইউ থেকে চূড়ান্তভাবে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়ার পরে দেশটিতে এ সুবিধায় আর পণ্য রফতানির সুযোগ থাকার কথা নয়। তবে এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে নতুনভাবে এ সুবিধা আদায়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। এটি সম্ভব না হলে রফতানি আয়ে বড় ধাক্কা লাগতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া যুক্তরাজ্যে অর্থনীতির বড় পতন হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এটি হলে দেশটিতে বেকারত্ব বাড়বে। বাংলাদেশি পোশাকের বাজারেও চাহিদা কমে যেতে পারে।
ব্রেক্সিট ঘটনার ফলে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা ও বৈশ্বিক মুদ্রাবাজার ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রবণতা ও মন্দা অবস্থার আশঙ্কা রয়েছে, পাশপাশি অন্যান্য মুদ্রার সঙ্গে পাউন্ডের বিনিময় হার কমে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই ডলারের বিপরীতে পাউন্ড ১০ শতাংশ এবং ইউরোর বিপরীতে ৩ শতাংশ কমেছে, যেটির ধারা বাংলাদেশকে প্রভাবিত করতে পারে। ডলারের বিপরীতে পাউন্ড স্টারলিং ও ইউরোর অবমূল্যায়ন বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে বিশেষ করে তৈরি পোশাক রফতানিতে নেকিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক রফতানির ৫৫ শতাংশ ইইউভুক্ত দেশগুলোতে ও ১২ শতাংশ যুক্তরাজ্যে গিয়ে থাকে। ফলে ডলার ও টাকার অংকে রফতানি আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাউন্ডের বিপরীতে টাকার অতিমূল্যায়ন হলে বাংলাদেশে প্রতিযোগী সক্ষমতা কমে যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে পাউন্ডের দর কতটুকু কমে তার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের প্রতিযোগী সক্ষমতা কতটুকু কমবে।
বাংলাদেশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর সিংহভাগ আসার কথা ইউরোপ থেকে।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩১ বিলিয়ন ডলারের যে রফতানি আয় হয়েছে তার মধ্যে ইউরোপ থেকেই এসেছে ১৭ বিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি ব্রেক্সিটের ফলে গোটা ইউরোপেই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে নতুন করে বিশ্বমন্দা দেখা দিতে পারে। ইউরোপের অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ইউরোপের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য। কমে যেতে পারে বাংলাদেশ থেকে রফতানি। যাতে রফতানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন নাও হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছে সংগঠনটি। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমি বলছি না ইউরোপে আমাদের রফতানি কমে যেতে পারে। তবে সামনে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তাতে আমাদের সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তিনি বলেন, ইইউ-এর মাধ্যমে আমরা যুক্তরাজ্যে রফতানিতে যে সুবিধা পেতাম তা যাতে অব্যাহত থাকে এজন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে। তিনি বলেন, চূড়ান্তভাবে ইইউ থেকে যুক্তরাজ্য বিচ্ছিন্ন হতে যে সময়টুকু পাওয়া যাবে তার মধ্যেই দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের দিকগুলো ঠিক করে ফেলা দরকার।
সিপিডির এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, দেশটিতে অর্থনীতির যে মন্দা দেখা দিতে পারে, তার প্রভাবে তারা বিশ্বব্যাপী যে ১৭ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য দিয়ে থাকে তা কাঁটছাট হতে পারে। বাংলাদেশেও তাদের সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলোতে সাহায্যের পরিমাণ কমে যেতে পারে। পাশাপাশি কমে যেতে পারে তাদের বিনিয়োগ। এছাড়া পাউন্ডের দরপতন এবং যুক্তরাজ্যের মন্দা শুরু হলে দেশটি থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহও কমে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
ব্রেক্সিটের ঘটনার পরপরই সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ইইউ-এর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়তে ১০ বছর সময় লেগেছিল। এবার যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সেই সম্পর্ক নতুন করে গড়তে হবে। এটি সময়সাপেক্ষ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ব্রিটেনে বাঙালি এমপি রুশনারা আলী জানিয়েছেন, ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশিরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গড়পড়তায় চাকরি হারাবেন প্রায় পাঁচ লাখ। এতে বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বাংলাদেশিসহ সংখ্যালঘুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এদিকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী সংগঠন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আইন বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপযুক্ত প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় কমিটি গঠন করতে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্যের সঙ্গে দ্রুত কূটনৈতিক দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বা মধ্যস্থতার উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
মানবকণ্ঠ/এফএইচ
Published in সকালের খবর on Sunday, 26 June 2016
ব্রেক্সিট-পরবর্তী যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত
ব্রেক্সিট-পরবর্তী যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতনিজস্ব প্রতিবেদক: স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৮টি দেশে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে। কিন্তু যুক্তরাজ্যের জনগণ ব্রেক্সিটের (ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়া) পক্ষে রায় দেওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, পাউন্ডের ব্যাপক দরপতন হওয়ায় তাত্ক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের রফতানি ও প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই রায় বিশ্ব অর্থ-ব্যবস্থার জন্য বড় ধরনের আঘাত। এটা আধুনিক বিশ্বায়নের নীতির পরিপন্থী। এ অবস্থায় ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া সম্পন্নের দু’বছরের মধ্যে ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের, যাতে করে ইইউতে পণ্য রফতানিতে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাংলাদেশ পেত, তা যেন অব্যাহত থাকে। অনুরূপভাবে অন্যান্য পৃথক দেশের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সকালের খবরকে বলেন, ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় আসাটা উদ্বেগের। এ সিদ্ধান্ত বিশ্ব অর্থ-ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা তৈরি করবে। যার তাত্ক্ষণিক প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। তিনি বলেন, ব্রেক্সিটের পাউন্ডের ব্যাপক দরপতন ঘটেছে। দরপতনের এই মাত্রা দীর্ঘায়িত হয়তো হবে না, কিন্তু শূন্যে ফিরে আসবে না। এতে বাংলাদেশের রফতানি প্রতিযোগিতায় সমস্যা তৈরি করবে। একই সঙ্গে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন কম পরিমাণের রেমিট্যান্স পাঠাবে। তারা এখন আর আগের মতো টাকা দেশে পাঠাবে না, মুদ্রার মান ফিরে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। তিনি আরও বলেন, ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় আসায় ইইউর অভ্যন্তরীণ সঙ্কট তৈরি হবে। স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন গণভোটের ঘোষণা করেছে। এমনকি ইইউর ভবিষ্যত্ নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আগেই ব্রিটেনের সঙ্গে কূটনৈতিক তত্পরতা বাড়াতে হবে। ইইউর কাছ থেকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমরা যেসব সুবিধা ভোগ করতাম, তা যেন ব্রিটেনের সঙ্গেও অব্যাহত থাকে, সে চেষ্টা করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সকালের খবরকে বলেন, ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসা বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদ। এ সিদ্ধান্তে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য, রেমিট্যান্স প্রবাহ, বৈদেশিক সহায়তা ও অভিবাসন নিয়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে। সেজন্য বাংলাদেশকে আগামী কয়েক মাস বেশ কৌশলের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ইইউর সঙ্গে যেসব চুক্তি ছিল তা যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও পৃথকভাবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে অব্যাহত রাখতে হবে। তারপরও এখন থেকে বেশি কিছুদিন আমাদের অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটবে।
তিনি বলেন, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, তারা কীভাবে ইইউ থেকে বের হচ্ছে। আমরা ইইউভুক্ত ২৮টি দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাই। যুক্তরাজ্য বেরিয়ে আসায় এখন আবার দ্বিপক্ষীয়ভাবে আমাদের চুক্তি করতে হবে। যাতে আমাদের ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে না হয়। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পর ব্রিটেন বাংলাদেশের রফতানির আয়ের তৃতীয় বৃহত্তর দেশ, যার ৯০ ভাগই তৈরি পোশাক খাতের। তিনি আরও বলেন, ব্রিটেনে তিন লাখের ওপরে বাংলাদেশি রয়েছে। ব্রেক্সিট হওয়ায় সেখানে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে। এখন সেখানকার বাংলাদেশিদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি জানান, প্রতিবছর প্রায় এক বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে, পাউন্ডের দর পড়ে যাওয়ায় টাকার অঙ্কে কম আসবে।
ড. মোস্তাফিজ আরও বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে যুক্তরাজ্য বেশ বড় সহায়তা দেয়। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যারা তাদের জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ সহায়তা দেয় ব্রিটেন তাদের মধ্যে অন্যতম। আইএমএফের প্রক্ষেপণে, ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে শ্লথগতি আসবে। এ অবস্থায় যেন বাংলাদেশের সহযোগিতার পরিমাণ না কমে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া ব্রিটেনে নতুন যে সরকার আসবে, তারা অভিবাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও বাইরে থেকে শ্রম নিতে বাধ্য হবে। সেজন্য বাংলাদেশকে নতুন সরকারের সঙ্গে শক্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। সর্বোপরি তিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কৌশলী ভূমিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মীর্জ্জা এবি মো. আজিজুল ইসলাম সকালের খবরকে বলেন, ব্রেক্সিটের পর বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে সেটা খুবই বড় ব্যাপার হবে না। তবে তাত্ক্ষণিকভাবে পাউন্ড এবং ইউরোর বিনিময় হারে বড় মাত্রার পার্থক্য হয়েছে, সেটা অব্যাহত থাকলে রফতানির জন্য ভালো হবে না। এছাড়া ইইউ দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে যেসব শ্রমিক যাওয়ার সুযোগ পেত, অভিবাসন নীতিতে আরও কড়াকড়ি করায় সে সুযোগ সঙ্কুচিত হবে।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তর রফতানি আয়ের দেশ। সেখানে প্রতিবছর তিন বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়। প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি বৈধ-অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস করে। যারা প্রতিবছর পৌনে এক বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠায়। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এই বাজার কোনো অবস্থায় হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সকালের খবরকে বলেন, গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আর্থিক খাতে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করা শুরু করেছে। পাউন্ডের রেকর্ড পতন ঘটেছে। সে ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থেকে এখনই আমাদের পৃথকভাবে চুক্তির চেষ্টা করতে হবে। কেননা ইইউ থেকে বেরিয়ে এলেও ব্রিটেনে তৈরি পোশাকের চাহিদা কিন্তু কমে যায়নি। তিনি বলেন, ব্রেক্সিট আসলে অভিবাসনের বিরুদ্ধে রায়। ফলে সে দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের প্রতি একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর নজরদারি বাড়বে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশিদের যাওয়ার পথও সঙ্কুচিত হবে। এতে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাজ্য থেকে স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে ব্রিটেন দুর্বল হয়ে যেতে পারে। সার্বিকভাবে এটা ভালো হয়নি। এ সিদ্ধান্ত আধুনিক বিশ্বায়নের নীতির পরিপন্থী। রক্ষণশীলতার হুঙ্কার। এ ধরনের রায় আসবে সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। তিনি ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কুফল সম্পর্কে প্রচারণার অভাব ছিল বলে মনে করেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত সকালের খবরকে বলেন, ব্রেক্সিটের পর মুদ্রাবিনিময় হারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে, যা আর্থিক অস্থিতিশীলতা পূর্ব লক্ষণ। তাছাড়া রফতানিতে জিএসপিতে যে সুবিধা বাংলাদেশ পায়, সেটায় যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে খুব একটা বেশি সমস্যা হবে না। ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে যে সুবিধা আমরা পাই, আশা করা যায় ইংল্যান্ডের কাছ থেকেও তাও পাব। তিনি আরও বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগে যেভাবে ছিল, সেটা দুর্বল অবস্থায় ছিল। এই পরিবর্তনে যদি ইংল্যান্ডের অর্থনীতি বেগবান হয়, তাহলে বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। আর যদি নাজুক হয়, তাহলে আরও খারাপ হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ. মানসুর সকালের খবরকে বলেন, রফতানি বাণিজ্যে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। পরিবর্তিত অর্থনীতি যদি খারাপ হয়, তাহলে আমাদের জন্য খারাপ হবে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে নেতিবাচব প্রভাব পড়ে, তাহলে সেটাও আমাদের অর্থনীতির জন্য খারাপ হবে।
তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এখন যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সেই সিদ্ধান্ত যেন বলবত্ রাখে সেজন্য বাংলাদেশকে তত্পর হতে হবে। এছাড়া পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়বে। কারণ ইইউ থেকে বের হয়ে গেলে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা কী ধরনের হবে তার ওপর গোটা বিষয়টি নির্ভর করছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ সকালের খবরকে বলেন, রক্ষণশীলদের প্রচারণায় পরিণাম না ভেবে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় এসেছে, এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কারও জন্যই ভালো সংবাদ নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক অর্থ ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোনত দেশকে নতুন সম্পর্ক তৈরির চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে। ইইউ থেকে বেরিয়ে যুক্তরাজ্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা রাখবে কি না, অভিবাসন ইস্যুতে তারা কী সিদ্ধান্ত নেবে, এসব বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের পোশাক রফতানির বড় বাজার। সেই বাজার যেন হাতছাড়া না হয়, সে ব্যাপারে তত্পর থাকতে হবে।