Published in প্রথম আলো on Saturday, 31 December 2016
আরও একটি বছর শেষ হলো। দেশের অর্থনীতি, আর্থিক খাতের জন্যও বছরটি ছিল আলোচিত-সমালোচিত। অর্থনীতিতে স্বস্তির পরশ যেমন ছিল, তেমনি ছিল দুশ্চিন্তার কারণও। যা কিছুই ঘটুক অর্থনীতিতে, এর প্রভাব এসে পড়ে মানুষের ওপর। বছরজুড়ে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিশ্লেষণ ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলেছেন ২০১৬ সালটির ভালোমন্দ। প্রথম আলোর এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন ও রাজীব আহমেদ
প্রথম আলো: ২০১৬ সালটি দেশের অর্থনীতির জন্য কেমন ছিল?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: মোটা দাগে বলতে গেলে বছরটিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেকগুলো সূচক স্থিতিশীল ছিল। অর্থনীতির যেসব সূচক সরাসরি সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে, সেসব সূচকের বেশ কয়েকটি স্বস্তিদায়কই ছিল বলা চলে।
প্রথম আলো: অর্থনীতির কোন সূচকগুলো ইতিবাচক ছিল? যার জন্য সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে ছিল বলে মনে করছেন।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় ছিল। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে এ সূচকটি। এ ছাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদন পরিস্থিতি ভালো থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যও সহনীয় ছিল। এ কারণে সাধারণ মানুষ, তথা সীমিত আয়ের মানুষকে বড় ধরনের কোনো অসহনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে যদি দেশেও যথাসময়ে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত, তাহলে দ্রব্যমূল্যে কিছুটা হলেও তার সুফল পাওয়া যেত। এর বাইরে ২০১৬ সালটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যও বেশ স্বস্তির ছিল। এ বছরটিতে তাঁদের বেতন-ভাতা বেড়েছে।
প্রথম আলো: অর্থনীতির আর কোন কোন সূচক ইতিবাচক ছিল বলে মনে করেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: ব্যাংকিং খাতে ঋণের সুদহার নিম্নমুখী ছিল। এটি বিনিয়োগের জন্য সহায়ক। যদিও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে আমরা কাঙ্ক্ষিত গতি দেখতে পাইনি। এ ছাড়া শিল্প খাতের পরিবেশ, উৎপাদন পরিস্থিতি, মোট দেশজ উৎপাদন বা জাতীয় প্রবৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোও ইতিবাচক ছিল এ বছরটিতে। প্রথমবারের মতো ৭ শতাংশের বেশি জাতীয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে আমাদের এ বছরটিতে। যদিও এ প্রবৃদ্ধি নিয়ে কারও কারও মনে কিছুটা সংশয় রয়েছে। তা সত্ত্বেও যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখ করার মতোই।
এ ছাড়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ, রাজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্যোগ, বিদেশি শ্রমশক্তি রপ্তানিও অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
প্রথম আলো: বছরটিতে অর্থনীতির জন্য খারাপ বা নেতিবাচক কিছু ছিল কি?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: ২০১৬ সালজুড়ে সরকারের মধ্যে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা ও চুক্তি স্বাক্ষরের প্রতি বেশ আগ্রহ দেখা গেছে। তার বিপরীতে চলমান কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যাশিত গতি দেখতে পাইনি। বেসরকারি বিনিয়োগেও ছিল শ্লথগতি। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় কমে যাওয়া বছরটিতে দুশ্চিন্তার কারণ ছিল।
প্রথম আলো: তরুণ জনগোষ্ঠীর আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো ঘটনা কি বছরটিতে ছিল?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালেও আমরা তরুণদের মধ্যে স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রবণতা দেখেছি। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। এর ফলে আরও অনেকেই উৎসাহিত হবে। এ স্বকর্মসংস্থান উদ্যোগের কারণে প্রচ্ছন্নভাবে বেকারত্ব কমছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে বেশ কিছু সহায়ক কর্মসূচি বা উদ্যোগও ছিল বছরজুড়ে। এটিও তরুণদের আশাবাদী হওয়ার মতো। তবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ার প্রবণতা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ছিল এ বছরটিতেও।
প্রথম আলো: ২০১৬ সালটি আর্থিক খাতের জন্য কেমন ছিল বলে মনে করেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: এ বছরটিতেই আর্থিক খাতে বিশ্বজুড়ে আলোচিত রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার বিষয়টি জানতে পারলাম। আবার চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে বছরজুড়ে যে চেষ্টা বা উদ্যোগ ছিল, তাতেও একধরনের সমন্বয়হীনতার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ ছাড়া যথারীতি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অনিয়ম ও মূলধন ঘাটতিতে পড়ার বিষয়টি ছিল উদ্বেগজনক। এ মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকার জনগণের করের টাকায় মূলধন জোগান দিয়েছে। ব্যাংকিং খাতে সংস্কার না করে এ মূলধন জোগান দেওয়ায় তার খুব বেশি সুফল পাওয়া যায়নি।