Published in প্রতিদিনের সংবাদ on Saturday, 28 January 2017
২৬৬ এনজিওর পকেটে ১৫ হাজার কোটি টাকা
দেশের তিন ধরনের ২৬৬টি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এসব এনজিও সমবায় অধিদফতরে নিবন্ধিত। নামে-বেনামে গজিয়ে ওঠা এসব সংস্থা বিভিন্ন সময় গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলে বিশেষ কৌশলে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ও অনিয়মের তথ্য মিলেছে খুব কম সময়ের মধ্যে পরিচিতি পাওয়া চারটি এনজিওর বিরুদ্ধে। এগুলো হলো ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, ম্যাক্সিম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, আইডিয়াল কো-অপারেটিভ লিমিটেড এবং অগ্রণী মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ লিমিটেড।
সরকারের সমবায় অধিদফতরের হালনাগাদ ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের এসব তথ্য মিলেছে। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর অধিদফতর এ প্রতিবেন প্রকাশ করে। পরে তা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে জমা দেয়। পর্যালোচনা শেষে দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ জানাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব এনজিও প্রথমে চটকদারি কথা এবং নানা মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের এই খাতে বিনিয়োগ করায় ও পরে সেই অর্থ হাতিয়ে নেয়। এমনকি এসব এনজিও গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা অর্থে দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় ও অট্টালিকা গড়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, যারা অস্বচ্ছ কাজ করেন তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধান চালানো বা দেখভাল করার প্রয়োজন রয়েছে। যদি কাজে-কর্মে অস্বচ্ছতা দেখতে পান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। দেখা যায়, অনেক সময় এনজিওগুলোর যেভাবে কাজ করার কথা সেভাবে করে না। ফলে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হন। ক্ষতিগ্রস্ত হন গ্রাহকরা। সময়মতো সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলে এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। কিন্তু এক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের গাফলতি দেখা যায় যা কারো কাম্য নয়। ‘কিন্তু যারা ভালো কাজ করছে, সেসব সংস্থা যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন সে বিষয়েও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। সরকারের এ ধরনের উদ্যোগের কারণে যাতে তাদের কর্মকাণ্ডে ব্যাহত না হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে’ বলে জানান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।
অবশ্য সমবায় অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের কঠোর নজরদারি ও হস্তক্ষেপের কারণে অনেক এনজিও তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করছেন সীমিত পরিসরে। বিভিন্ন সময়ে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে গণমাধ্যমের মাধ্যমে দেশবাসীর সামলে তুলে ধরতে সরেজমিন পরিদর্শন করানো, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম করে থাকলেও বর্তমানে পুরোপুরি এসব থেকে এড়িয়ে চলছে এনজিওগুলো। আগ বাড়িয়ে কিছু করতে গিয়ে সরকারের রোষানলে পড়তে চায় না তারা। ফলে ধীরলয়ে অনেকটা নিরবে এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একাধিক এনজিওর নীতি-নির্ধারকের সঙ্গে আলাপে এসব তথ্য তারা এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙা বলেন, যেসব এনজিওর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো আমার সময় নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। তবে এ কথা বলতে পারি, অভিযুক্ত সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এনজিওগুলো যেন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে রাজনৈতিকভাবেও ব্যবহার না হতে পারে, আমরা সেদিকটাও দেখছি।
অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন সময় বেশকিছু এনজিওর বিরুদ্ধে সরকার হঠানো তৎপরতার অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে একটি প্রতিষ্ঠিত এনজিওর বিরুদ্ধে তৎকালীন বিরোধী দলের সঙ্গে মিশে সরকার হঠানোর কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার গুরুতর অভিযোগ ওঠে। তখন থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার এসব এনজিওর ওপর কঠোর নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এনজিওদের অর্থের উৎস তালাশে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নির্দেশ দেন। সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এনজিওগুলো নিজেদের গুটিয়ে নেয়। সতর্ক হয়ে পড়ে অন্যান্য এনজিওগুলো।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বহুমুখী সমবায় সমিতি, সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি এবং অন্যান্য- এই তিনটি ক্ষেত্রে মূলত ক্ষুদ্র বিনিয়োগের লক্ষ্যে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নিবন্ধন দেয় সমবায় অধিদফতর। বর্তমানে সারাদেশে এ ধরনের ৮৭ হাজার ১১২টি নিবন্ধিত সংস্থা রয়েছে। এর মধ্যে বহুমুখী সমবায় সমিতির নামে নিবন্ধন নেওয়া ১৪ হাজার ২৫০টি সংস্থার মধ্যে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ২২১টি, সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির নামে নিবন্ধিত ১৪ হাজার ৮৬১টির মধ্যে ২৪টি এবং অন্যান্য ক্যাটাগরিতে নিবন্ধন পাওয়া ৫৮ হাজার ১০৭টি এনজিওর মধ্যে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়া সমিতির সংখ্যা ২১টি। অর্থাৎ মোট ২৬৬টি এনজিওর বিরুদ্ধে এসব অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অভিযুক্ত ২৬৬টি সংস্থার মধ্যে ৭৬টি সংস্থার কর্তৃপক্ষ সদস্য বা অসদস্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা আমানতের নির্ধারিত অর্থের চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে। অপরদিকে, ১৯০টি এনজিও সংগৃহীত অর্থের চেয়ে কম বিনিয়োগ করেছে। ৭৬টির সংগৃহীত মূলধনের পরিমাণ ছিল ৪৭৩ কোটি ৫৮ লাখ ৮১ হাজার ১১৭ টাকা ও তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৬৩৭ কোটি ৭৬ লাখ ৭ হাজার ৯৮ টাকা; যা মূলধন সংগ্রহের চেয়ে ১৬৪ কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার ৯৮১ টাকা বেশি।
একইভাবে, সংগৃহীত মূলধনের চেয়ে বিনিয়োগ কম হওয়া ১৯০টি এনজিও’র সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ ৩ হাজার ৬৬৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার ৮০৮টাকা। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ১৪ কোটি ৭ লাখ ৪ হাজার ৩৩৫ টাকা। এসব সংস্থা গ্রাহকদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে তার থেকে অর্ধেক বিনিয়োগ করেছে; যার পরিমাণ ১ হাজার ৬৫১ কোটি ৮৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা।
অডিট রিপোর্টের আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কম সময়ে বেশি প্রচার পাওয়া চারটি সংস্থা সবচেয়ে বেশি অর্থ নয়-ছয় করেছে। এগুলো হলো ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, ম্যাক্সিম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, আইডিয়াল কো-অপারেটিভ লিমিটেড এবং অগ্রণী মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ লিমিটেড। এই চারটিসহ উল্লেখিত ২৬৬টি সংস্থা প্রায় ১ হাজার ৪৮৭ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার ৪৯২ টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া সংস্থাগুলো নিজেদের নামে যে সব জমি, ফ্ল্যাট, অফিস স্পেস বা দোকান বরাদ্দ নিয়েছে বা কিনেছে সেগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রেই ক্রয়মূল্য না দেখিয়ে বাজার মূল্য দেখিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনগড়া বাজার মূল্য দেখিয়েছেন সম্পদ কেনা ও বিনিয়োগে সংস্থার কর্ণধাররা। ফলে বেশি মূল্য বিনিয়োগ দেখিয়ে আর্থিক অনিয়ম বা গ্রাহকদের মুনাফা লুটপাট করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সংস্থার অর্থে স্থায়ী সম্পদ কেনা হলেও সেগুলো সংস্থার নামে না কিনে সংস্থার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বা সম্পাদকের নিজের নামে কেনা হয়েছে। পরস্পর যোগসাজশে অর্থ লোপাটের আশ্রয় নেওয়ায় সমুদয় অর্থ আত্মসাতের শামিল বলে গণ্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে এ কথাও বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ খাতে যে বিনিয়োগ দেখিয়েছে সংস্থাগুলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন খাতে কত টাকা বিতরণ করা হয়েছে বিস্তারিত তালিকা নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। সবক্ষেত্রে ধোঁয়াশা তৈরি করে সংস্থার কর্ণধাররা গ্রাহকদের এবং সরকারের কর ফাঁকি দিয়ে নিজেদের বিত্ত-বৈভব এবং আখের গুছিয়েছেন।