গণতন্ত্র ও আদর্শের অভাবে সম্পদ দখলের লড়াই হচ্ছে: রেহমান সোবহান

Published in বণিক বার্তা on Friday, 17 February 2017

গণতন্ত্র ও আদর্শের অভাবে সম্পদ দখলের লড়াই হচ্ছে —রেহমান সোবহান

নিজস্ব প্রতিবেদক

Rehman Sobhan

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, গণতন্ত্র ও আদর্শ না থাকায় এখন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা সম্পদ দখলের লড়াইয়ে মেতে উঠেছেন। আদর্শের জন্য নয়, কী পরিমাণ অর্থ বিতরণ হচ্ছে, তার দখল নিতেই লড়াই চলছে। গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এক কর্মশালায় এ কথা বলেন তিনি।

‘রাজনীতি, উন্নয়ন: গণতন্ত্র ও প্রবৃদ্ধি’ শীর্ষক এ কর্মশালার আয়োজন করে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও যুক্তরাজ্যের সংস্থা ইফেক্টিভ স্টেটস অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (ইএসআইডি)। এতে বাংলাদেশের উন্নয়ন, সুশাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা হয়। মোট তিনটি সেশনে গবেষকরা নির্বাচিত বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। কর্মশালার তৃতীয় সেশনের সমাপনী বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

তিনি বলেন, মানুষ আদর্শ দ্বারা চালিত হবে, এটা এখন কথার কথা। আদর্শ কেবল জাতীয় দিবসগুলোয় ভাষণ দিতে ব্যবহার হয়। এর বদলে ব্যক্তিগত উন্নয়ন শক্তিশালী আদর্শ।

উন্নয়ন বিষয়ে তিনি বলেন, শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে উন্নয়ন পরিমাপ করলে তা সঠিক পর্যালোচনা হবে না। রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেকটি খাতকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রবৃদ্ধি বাড়লেই হবে না, গুণগত মানও যাচাই করতে হবে। এখানে উন্নয়নের পাশাপাশি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

রেহমান সোবহান আরো বলেন, বিগত ২৫ বছরে বাজেটের আকার বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। মূলত সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এটি হয়েছে। এ ধরনের সরকারি ব্যয়ে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাতে রাজনীতিবিদরা সম্পদের মালিক হয়েছেন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে সমন্বিত কোনো আদর্শ নেই। বড় দুই দলের প্রতিযোগিতা মূলত সম্পদ বানানোর জন্য, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। একদলীয় প্রভাবাধীন ব্যবস্থার কারণে এখন সম্পদ ও পদের ভাগাভাগি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই সংঘাত বাড়ছে।

এর আগে আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সংসদ সদস্যরাও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বণ্টন চান। তা না হলে তারা পরবর্তী নির্বাচনে টিকতে পারবেন না। অর্থনীতিকে সুসংহত করার জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা ও ধারাবাহিক নির্বাচনের প্রয়োজন রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেই হবে না, প্রবৃদ্ধির গুণগত মানও যাচাই করতে হবে। অর্থাত্ কোন প্রক্রিয়ায় প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, তা বিবেচনায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক চর্চা ও সুশাসনের প্রয়োজন। রাজনৈতিক পরিসরের  বাইরে সামাজিক পরিসরেও এখন গণতন্ত্র কাজ করছে না।  অর্থাত্ পেশাজীবী সংগঠনগুলোয় অনেক ক্ষেত্রেই সিলেকশন হয়ে যাচ্ছে।

ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ধারা তুলে ধরে সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একসময় সরকার বদলের সঙ্গে নীতি ও প্রকল্প বদল হতো। এর পর সরকার বদল হলেও নীতি ও প্রকল্প বদল হতো না। এর পর এমন সময় এল, যখন সরকার বদল হয়, নীতি ও প্রকল্প বদল হয় না, কিন্তু কন্ট্রাক্টর বদল হয়।  আর এখন সরকার বদলের সঙ্গে নীতি-প্রকল্প-কন্ট্রাক্টর কোনোটিই বদল হয় না, শুধু কন্ট্রাক্টরদের দল বদল হয়।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. মির্জা হাসান বলেন, বাংলাদেশে ২০১৩ সালের পর প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবসান হয়েছে। উন্নয়নের একটি লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখন কর্তৃত্বশীল দলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে খাজনা আদায় বা ভাগবাটোয়ারার ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত হয়েছে; বেড়েছে বিনিয়োগ ব্যয়। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচনী জবাবদিহিতা কমেছে। বাংলাদেশের আমলারা রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। তাদের জবাবদিহিতা নেই।

অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান, যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড হিউম, বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক সুলতান হাফিজ রহমান, সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, জেমকন গ্রুপের পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ, ড. সোহেলা নাজনীন, সিমীন মাহমুদ ও ড. নওমী হোসেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।