Published in প্রথম আলো on Monday, 13 March 2017
ঘোষণা দিয়েও চালু হয়নি ১৩ স্থলবন্দর
চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা শুল্ক স্টেশনকে ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি স্থলবন্দর ঘোষণা দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য হলো এ সীমান্ত দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সহজ করা। এ জন্য গুদামঘর, কার্যালয়, সংযোগ সড়ক—সবই তৈরি করার কথা ছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরেও এখানে কোনো অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। এমনকি স্থলবন্দরে যাওয়ার সংযোগ সড়কও নেই। এ স্থলবন্দরটির কার্যক্রম পরিচালনা আর সম্ভব নয়। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে রেলপথে দর্শনা শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে।
সিলেটের তামাবিল শুল্ক স্টেশনকেও ২০০২ সালে স্থলবন্দর ঘোষণা দেওয়া হয়। এত বছরেও এটিকে স্থলবন্দর হিসেবে চালু করা যায়নি। এখনো শুল্ক স্টেশন হিসেবে চলছে। তবে সীমানাপ্রাচীর, ইয়ার্ড ও গুদাম নির্মাণের কাজ চলছে। সিলেট থেকে তামাবিল পর্যন্ত প্রায় ৪২ কিলোমিটার সড়কটি বেশ সরু ও ভাঙাচোরা। সম্প্রতি সড়কটি প্রশস্ত করতে অর্থায়নে রাজি হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
অন্যদিকে ২০০৯ সালে ফেনীর বিলোনিয়া স্থলবন্দর ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সাত বছরেও কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এমনকি জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবে শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলছে।
স্থলবন্দর ঘোষণা দেওয়া হলেও কোনো কার্যক্রম নেই—এমন ১৩টি স্থলবন্দর আছে। এসব স্থলবন্দরে কোনো অবকাঠামোও তৈরি হয়নি। শুধু নামের স্থলবন্দর। এই স্থলবন্দরগুলো হলো তেগামুখ (রাঙামাটি), সোনাহাট (কুড়িগ্রাম), চিলাহাটি (নীলফামারী), দৌলতগঞ্জ (চুয়াডাঙ্গা), ধানুয়া কামালপুর (জামালপুর), শেওলা (সিলেট), গোবরাকুড়া-কড়ইতলী (ময়মনসিংহ), দর্শনা (চুয়াডাঙ্গা), তামাবিল (সিলেট), বিলোনিয়া (ফেনী), রামগড় (খাগড়াছড়ি), বিরল (দিনাজপুর) ও বাল্লা (হবিগঞ্জ)। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রেই এসব তথ্য জানা গেছে।
২০০১ সালে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি স্থলবন্দর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি স্থলবন্দর হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। অর্ধেকের বেশি বা ৫৭ শতাংশ স্থলবন্দরের কোনো কার্যক্রম নেই। হবিগঞ্জের বাল্লা স্থলবন্দরের বয়স মাত্র এক বছর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এসব স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করার মতো অবকাঠামো অপর্যাপ্ত ও অপ্রতুল। ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সহজ করতে হলে এসব স্থলবন্দরের অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। আমদানি-রপ্তানির কাজে সম্পৃক্ত অফিসগুলো স্থাপন করতে হবে। তবে সীমান্তের এপারে বাংলাদেশ অংশে শুধু অবকাঠামো নির্মাণ করলেই হবে না, ভারত অংশেও করতে হবে। তাঁর মতে, স্থলবন্দরকেন্দ্রিক অবকাঠামো নির্মাণসহ বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিত করতে পরলে আমদানি পণ্যের খরচ কমবে, যা ভোক্তার সুবিধা। আবার প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।
স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ১৩টি স্থলবন্দরের সবগুলোই অবকাঠামো না থাকায় চালু করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে তিনটি স্থলবন্দর ঘোষণা হয়েছে ১৫ বছর আগে। আর ঘোষণার দিক থেকে ৫ থেকে ১০ বছরের পুরোনো আছে দুটি। গত দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সাতটি স্থলবন্দর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তামাবিল ও সোনাহাট স্থলবন্দর ছাড়া এখন বাকি স্থলবন্দরগুলোর উন্নয়নে কোনো প্রকল্প নেই।
তবে রাঙামাটির তেগামুখ স্থলবন্দরের সমস্যা একটু ভিন্ন প্রকৃতির। ২০১৩ সালে ঘোষণা দেওয়া এ স্থলবন্দর নিয়ে আপত্তি করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিষদ। স্থলবন্দর হলে স্থানীয় লোকজনের (আদিবাসী) সংস্কৃতি হুমকির সম্মুখীন হতে পারে বলে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে পরিষদ। এমন অবস্থায় গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও চারটি স্থলবন্দর তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (উন্নয়ন) মেশকাত আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, যেসব স্থলবন্দর চালু হয়নি, সেগুলোর বেশির ভাগের অন্যতম সমস্যা হলো সংযোগ সড়ক নেই। এসব স্থলবন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ করেও লাভ হবে না, যদি সংযোগ সড়ক না থাকে। আর সংযোগ সড়ক তৈরির বিষয়টি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে নেই। এটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাজ। তিনি জানান, সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করছে কর্তৃপক্ষ। শিগগিরই এর সমাধানের আশা করা হচ্ছে।
এদিকে গত সাত বছরে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের মুনাফা দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মুনাফা হয়েছে ৩১ কোটির টাকার বেশি। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি টাকা। সরকারের কোষাগারে অর্থ জমা দেওয়ার পরও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের স্থায়ী আমানতের পরিমাণ বাড়ছে। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত স্থায়ী আমানতের স্থিতি হলো ১৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অলস পড়ে আছে। সাত বছরে এ ধরনের আমানত চার গুণ বেড়েছে।
স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষই বেনাপোল, আখাউড়া, বুড়িমারী, ভোমরা ও নাকুগাঁও স্থলবন্দর পরিচালনা করে। পাঁচটি স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা, সোনামসজিদ, হিলি, টেকনাফ ও বিবিরবাজার বেসরকারি পোর্ট অপারেটররা চালায়। কথা ছিল বেসরকারি অপারেটররা অবকাঠামো তৈরি করে স্থলবন্দর চালাবে এবং এর বিনিময়ে আয়ের একটি অংশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে দেবে। এসব অপারেটরের কাছে বকেয়া প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।