Published in সমকাল on Saturday, 18 March 2017
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সামনে এখন বড় লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ৪ লাখ কোটি টাকার মতো। আমাদের চলতি বছরের উন্নয়ন ও রাজস্ব বাজেটের পরিমাণ ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছর এর পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা হতে পারে, এমন ধারণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এর সঙ্গে রফতানি লক্ষ্যমাত্রার তুলনা করে আমরা চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময়েই আমাদের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে আরেকটি বড় ঘটনা ঘটতে চলেছে_ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সারিতে উত্তরণ। এ লক্ষ্যে পেঁৗছাতে হলে পোশাক শিল্পকে নিতে হবে বিশেষ ভূমিকা। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হচ্ছে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। ২০২১ সালের একটি রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে_ এ বছরেই পালিত হবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সিংহভাগ আসে পোশাক খাত থেকে। শিল্প শ্রমিকদের বড় অংশও এ খাতে নিয়োজিত। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এ শিল্পের গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি। পরবর্তী চার বছরের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা, তাতে সন্দেহ নেই। যদি তাতে বড় ধরনের ঘাটতি থাকে তাহলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে পেঁৗছানোর পথেও আমাদের হোঁচট খেতে হবে।
পোশাক শিল্পের উৎপাদক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘বাংলাদেশ আরএমজি রোডম্যাপ :২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন’ শিরোনামে। এ রোডম্যাপে বলা হয়, বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রগতির যে হার এবং বিশেষ করে রফতানি যে হারে বাড়ছে (২০১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.২ শতাংশ), সেটা অব্যাহত থাকলে মাত্র চার বছর পর এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন। পোশাক শিল্পের সঙ্গে যুক্তরাই বলছেন, বর্তমান হার বজায় থাকলে ২০২১ সালে রফতানি বড়জোর ৪৩ বিলিয়ন ডলারে পেঁৗছাতে পারে। সঙ্গত কারণেই উপসংহার_ ২০২১ সালের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বছরে ১.৮ শতাংশ বেশি রফতানি করতে হবে।
লক্ষ্য অর্জন করতে হলে কী করণীয়, কোথায় অগ্রাধিকার_ সেটা স্পষ্ট বলেছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন। যেমন_ অবকাঠামো, জ্বালানি, উৎপাদনশীলতা, অ্যাপারেল ডিপ্লোমেসি ও শ্রমিক ইস্যু। এর বাইরে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে রয়েছে নতুন বাজার অনুসন্ধান, গবেষণা ও উদ্ভাবন, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন ও ইথিকাল প্র্যাকটিস এবং রিলোকেশন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সর্বোচ্চ ও দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারসমূহ কি যথাযথ মনোযোগ পাচ্ছে? এর সঙ্গে কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সারিতে পেঁৗছানোর বিষয়টিও সরাসরি জড়িত।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে রফতানি বাণিজ্যে কিছু সুবিধা পাচ্ছে। এ ‘মর্যাদার’ কারণে সহজ শর্তে ও কম সুদে মিলছে বৈদেশিক ঋণ। কিছু অনুদানও মিলছে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে এ ‘মর্যাদা’ প্রকৃতপক্ষে অমর্যাদার কলঙ্কতিলক। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্য তাই সঙ্গত এবং তা অর্জন করতে পারা গৌরবের। বাংলাদেশ এ জন্য সচেষ্ট রয়েছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে পরবর্তী উন্নত ধাপে পেঁৗছানোর জন্য মূল্য দিতে হয়। এ অর্জনের কারণে বাংলাদেশকে নতুন কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। প্রথমেই বলা দরকার_ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পাওয়া কিছু ‘সুবিধা’ হারাবে কিংবা তার পরিমাণ কমে যাবে। কিছু শর্ত পুনর্নির্ধারিত হবে। অথবা নতুন শর্ত আরোপ করা হবে। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশ ‘অস্ত্র ছাড়া যে কোনো পণ্য রফতানিতে শূন্য হার’ শুল্ক সুবিধা ভোগ করে আসছে। উন্নয়নশীল দেশের সারিতে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে এ সুবিধা আর থাকবে না। তখন আমাদের রফতানি বাজার ধরে রাখতে হলে নতুন কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো তখন নতুন শর্ত আরোপ করবে। যেমন পরিবেশ, শ্রম, সুশাসন, বুদ্ধিবৃত্তিগত সম্পত্তি অধিকার, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট ইত্যাদি। সুতরাং বাংলাদেশকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। এ জন্য চাই সহায়ক আইন ও নিয়মকানুন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে যে সব নতুন শর্ত আসবে তা পূরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের করণীয় রয়েছে। তাদের দিক থেকে চাই বিশেষ প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ। এ সব টেকসই হতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। বেসরকারি খাতের শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা যেমন বাড়াতে হবে এবং এ জন্য সরকারের দিক থেকে সহায়তা দিতে হবে, তেমনি তাদের কর্মকাণ্ড নিয়মিত মনিটর করার পন্থা সরকারকে উদ্ভাবন করতে হবে। এভাবে নতুন মানে উন্নীত হতে হলে উৎপাদন ও রফতানি ব্যয় বেড়ে যাবে। রফতানি বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এটা বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে শূন্য শুল্ক সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে আলোচনাতেও বসতে হতে পারে। ইতিমধ্যে যে সব দেশ উন্নয়নশীল দেশের সারিতে পেঁৗছেছে তাদের জন্য যে বাণিজ্য শর্ত রয়েছে, তা আমাদের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য আরও কিছু জটিল সমস্যা রয়েছে। যেমন, কয়েকটি প্রধান উন্নত দেশের প্রবৃদ্ধির হার নিম্ন পর্যায়ে থেকে যাচ্ছে। অথচ তারাই আমাদের রফতানি পণ্যের, বিশেষত পোশাকের প্রধান বাজার। আরও মনে রাখতে হবে, গত দুই বছরে পোশাকের রফতানিতে ওঠানামা ছিল। এ অবস্থায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের রোডম্যাপ কীভাবে অর্জিত হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টদের তুলনায় সংরক্ষণবাদী নীতি অনুসরণ করবেন, এমনই ধারণা করা হচ্ছে। এর প্রভাব পোশাক রফতানির ওপরেও পড়তে পারে। তাহলে কি রফতানি লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে? আমার ধারণা, এ খাতে বছরে ৭.৫ শতাংশ রফতানি বৃদ্ধির প্রাক্কলন বাস্তবসম্মত এবং এটা ধরে রাখতে পারলে ২০২৪ সাল নাগাদ আমরা ৫০ বিলিয়ন ডলারে পেঁৗছাতে পারি। একই বছরটি কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশের সারিতে পেঁৗছানোর জন্য নির্ধারিত রয়েছে।
২০২৪ সালে এ দুটি লক্ষ্য অর্জন করতে হলে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে। এক. আরও ভালো প্রতিযোগিতা এবং দুই. আরও ভালো শ্রম ও কারখানা পরিবেশ। রোডম্যাপে প্রতিযোগিতায় আরও সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু কমপ্লায়ান্সের ইস্যুটি তেমন আলোচনায় নেই। প্রতিযোগিতায় টিতে থাকতে হলে উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং পণ্যের মান বাড়ানোর কাজ গুরুত্ব দিয়ে করা চাই। যদি বিদ্যমান বড় বাজারগুলোতে শূন্য শুল্ক সুবিধা হারাতে হয় তাহলে এর বিকল্প নেই। এমনকি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্যও আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে_ আমাদের এফএফএন ট্যারিফ দিতে হতে পারে। এ ধরনের শুল্ক বাংলাদেশের রফতানিকারকদের জন্য বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি করবে, সন্দেহ নেই। ফলে আমাদের পণ্য বিদেশের বাজারে আরও কস্টলি হবে, যা সেখানকার ভোক্তাদের নিরুৎসাহিত করবে। এ অবস্থায় উৎপাদকদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে_ পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমানো। একই সঙ্গে উৎপাদন বহুমুখী করা, ডিজাইনের উন্নয়ন, কমদামি পোশাকের পাশাপাশি আরও উন্নত মানের পোশাক উৎপাদন ইত্যাদি বিষয়ের প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে এ প্রতিযোগিতা তীব্র হবে এবং তার মাত্রা বাড়বে।
কমপ্লায়েন্স অনেক দিন ধরেই আলোচনায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন বা আইএলওর বিধিবিধান মেনে চলা, পরিবেশ দূষণ ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি কমিয়ে আনা_ এসব এখন গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নিয়মকানুন মেনে চলে সেজন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব রয়েছে। রোডম্যাপে কারখানার নিরাপত্তা ইস্যুটি গুরুত্ব পেয়েছে। নৈতিকতা-সংক্রান্ত কিছু বিষয়ও আলোচিত হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাত্রা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিষয় আমাদের কারখানাগুলোকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে। যেমন, শিল্প দূষণ ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন। উৎপাদকদের জন্য তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক।
রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সারিতে উত্তরণ_ এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আমাদের সামনে। এ দুটি লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আমাদের অবশ্যই বেটার কমপিটিটিভনেস ও বেটার কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা চাই।
অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)