Published in আলোকিত বাংলাদেশ on Friday, 6 October 2017
মৈত্রী সড়ক ধরে এসেছে ১ লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা
আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্পের সুফল নিয়ে সংশয়
মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার কাজ অনেকটা শেষ পর্যায়ে আছে। রেল সংযোগ প্রতিষ্ঠায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে নেয়া হয়েছে আরও একটি বড় প্রকল্প। আঞ্চলিক সংযোগের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকল্পটি এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ফাস্টট্র্যাক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে নতুন করে আলোচনায় আসছে আন্তঃসংযোগ প্রতিষ্ঠায় নেয়া এসব প্রকল্প। কাজ শেষ পর্যায়ে থাকা দুই কিলোমিটার রাস্তা দিয়ে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। এ অবস্থায় দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলে এসব প্রকল্প কোনো কাজে আসবে না বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
মিয়ানমারকে যুক্ত করে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক, সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক), বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর (বিসিআইএম-ইসি), বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টর টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) আওতায় নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ মহাসড়ক ধরে ৪০ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প। সেখান থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুমের দূরত্ব দুই কিলোমিটার। নাফ নদী এড়িয়ে শুধু এ পয়েন্টেই দেশটির সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। মিয়ানমার ছাড়াও চীন এমনকি থাইল্যান্ড পর্যন্ত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে এ দুই কিলোমিটারজুড়ে চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। শুরুতে ৫৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়কটির ব্যয় উন্নীত হয়েছে ৮৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকায়। সড়কটির ৯০ শতাংশ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বাণিজ্য ও সম্প্রীতি বাড়ানোর লক্ষ্যে নির্মাণ করা হলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে দেশছাড়া রোহিঙ্গাদের বড় প্রবেশপথে পরিণত হয়েছে সড়কটি। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার আশ্রয়ও মিলেছে নির্মাণাধীন সড়কটিতে।
সরেজমিন উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে মৈত্রী সড়কে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। এ সড়কের আশপাশে থাকা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের মংডু থানার বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা তামব্রু এলাকা দিয়ে সীমান্ত পার হয়েছেন। পরে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম থেকে মৈত্রী সড়কের পথ ধরে তারা বালুখালী ক্যাম্পে আসেন। রোহিঙ্গা সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছে এমন দেশি-বিদেশি সংস্থার যৌথ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসাদের প্রায় ৩৭ শতাংশ এসেছে স্থলপথে। সর্বশেষ হিসাবে ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে রোহিঙ্গা এসেছেন ৫ লাখ ৯ হাজার। এ হিসেবে এ মৈত্রী সড়ক ধরেই প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা এসেছেন বলে স্থানীয়রা মনে করছেন।
আঞ্চলিক সংযোগ উন্নয়নে বিপুল অর্থ বিনিয়োগে সড়কটি প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয়রা। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রক্রিয়াধীন ১০০ কিলোমিটার রেলপথে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইন জুড়ে দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন আছে তাদের। রেলের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয় করবে সরকার। এতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দেবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করায় দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ বিষয়ে অন্যান্য দেশের কাছে প্রতিকার চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির নেত্রী অং সান সু চি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে সমালোচিত হয়েছেন। এর ফলে ইয়াঙ্গুনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক অনেকটাই শীতল। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আঞ্চলিক সংযোগে নেয়া প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত সুফল আসবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এডিবির পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে অস্থিরতার কারণে এ অঞ্চলের দারিদ্র্যবিমোচন, আঞ্চলিক সহায়তা, টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার চলমান প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রায় একই ধরনের ধারণা পোষণ করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান। আলোকিত বাংলাদেশকে তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অবনতির কারণে দুই দেশের বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। সম্পর্কের উন্নতি না হলে বাণিজ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। আঞ্চলিক পর্যায়ে নেয়া প্রকল্পের বাস্তবায়নেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রভাব কিছুটা পড়বে বলে তিনি মনে করেন।
রোহিঙ্গা সংকটকে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমসাময়িক বিশ্বে বড় সমস্যাগুলোর একটি বলে দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। এ সমস্যার সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে তিনি সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। আলোকিত বাংলাদেশকে এই অধ্যাপক বলেন, রোহিঙ্গা নির্যাতন অব্যাহত থাকলে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হতেই থাকবে। এ অবস্থায় দুই দেশের আন্তঃসংযোগে নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো সুফল আসবে না। তিনি আরও বলেন, আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক সংযোগ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভৌগোলিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। এ দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি হলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কানেকটিভিটি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিভিন্ন ফোরামে যোগ দিয়ে যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে বিপুলসংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে কয়েক লাখ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থাগুলো বিপুল পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে। আঞ্চলিক সংযোগে এসব সংস্থার পক্ষ থেকে দেখানো হচ্ছে বিপুল পরিমাণ লাভের হাতছানি। সাসেক কানেকটিভিটির মাধ্যমে বাংলাদেশ বছরে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় করতে পারে বলে এডিবির এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ১১ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ‘সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২ : এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এতে এডিবি থেকে ৯ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া যাবে। রংপুর থেকে এ মহাসড়কের একটি অংশ লালমানিরহাটের বুড়িমারি ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৫০ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়নে ব্যয় হবে ৩ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতের ত্রিপুরা ও সেভেন সিস্টার্সভুক্ত রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনে এ সড়ক ব্যবহার করা হবে।
সড়কপথে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ানো ১৭টি সেতু ও বেশ কয়েকটি কালভার্ট সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ২ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ক্রস বর্ডার ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১ হাজার ৮৫১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা দেবে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা)।
এডিবির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সাসেকের আওতায় পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ছয় দেশের জাতীয় আয় বছরে ৭ হাজার কোটি ডলার বৃদ্ধি সম্ভব। এর মধ্যে বাংলাদেশের উৎপাদন বাড়বে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। আরও ৩০০ কোটি ডলার সাশ্রয় হওয়ায় বাংলাদেশের মোট লাভের পরিমাণ ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতার কারণে সাসেক অঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষের কাজের সংস্থান হবে বলে মনে করে এডিবি। এর মধ্যে বাংলাদেশে নতুন ৭৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের হাতছানি রয়েছে।