Published in প্রথম আলো on Monday, 6 November 2017
অন্য বাংলাদেশ
ইউরোপের শিশুর হাতে বাংলাদেশের খেলনা
একজন ফরাসি শিশু বাংলাদেশের খেলনা নিয়ে খেলছে। পুতুলের মতো জাপানি শিশুরা বাংলাদেশের পুতুল নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। আর স্প্যানিশ শিশুর হাতেও বাংলাদেশের খেলনা শোভা পায়। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এটা ভাবতেই ভালো লাগে। এই তিনটি দেশের পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোতে এখন বাংলাদেশি খেলনার ব্যাপক চাহিদা। প্রতিবছরই বাংলাদেশি খেলনার রপ্তানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশি খেলনা রপ্তানি বেড়েছে দুই হাজার গুণের বেশি। ছয় বছর আগে যেখানে বছরে মাত্র সাত হাজার ডলারের মতো খেলনা রপ্তানি হতো, এখন তা বেড়ে দেড় কোটি ডলারে পৌঁছেছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ১২৬ কোটি টাকা। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি খেলনার চাহিদা সামনে রেখে অবশ্য খেলনা কারখানা নির্মাণে বিনিয়োগেও আগ্রহী হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তারা। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) এবং এর বাইরে বেশ কয়েকটি রপ্তানিমুখী খেলনার কারখানা গড়ে উঠেছে।
খেলনা রপ্তানিতে উদ্যোক্তার জন্য কেমন সম্ভাবনা—এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সম্প্রতি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কুমিল্লা রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (ইপিজেডে) হাসি টাইগার নামে একটি কারখানা সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। ৪৬ হাজার বর্গফুটের এই কারখানা চালুর বছরে অর্থাৎ ২০১৪ সালে মাত্র ৪২ হাজার ডলারের খেলনা রপ্তানি করেছে। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই (জানুয়ারি-জুলাই) রপ্তানির পরিমাণ নয় লাখ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের বিভিন্ন ইপিজেডে দুটি খেলনা কারখানা আছে। হাসি টাইগার এর একটি। নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে সনিক লিমিটেড নামে আরেকটি খেলনা কারখানা আছে।
ইপিজেডের বাইরে আরও কয়েকটি কারখানা আছে। এর একটি চট্টগ্রামের আনোয়ারায় গোল্ডেন সন নামের প্রতিষ্ঠান আছে। এটি দেশি প্রতিষ্ঠান। শিশুদের জন্য খেলার সামগ্রী তৈরি করে অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি করে থাকে। এ ছাড়া গাজীপুরের বে অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনের খেলনা উৎপাদক প্রতিষ্ঠান মাল্টিটেক ইন্টারন্যাশনালের একটি কারখানা করেছে। এই কারখানা ইতিমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে এবং চলতি নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে রপ্তানি শুরু হবে। বে অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্মকর্তারা জানান, মাল্টিটেক ইন্টারন্যাশনাল যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জন্য খেলনা তৈরি করে। বাংলাদেশের কারখানাটি বিশিষ্ট ব্যক্তি ও তারকাদের প্রতিকৃতির খেলনা তৈরি করবে।
সরেজমিনে হাসি টাইগার
২০১৪ সালে জাপানের খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হাসিমোতো গ্রুপের উদ্যোগে হাসি টাইগার লিমিটেডের কারখানাটি নির্মাণ করা হয়। ইপিজেডে নির্মিত শতভাগ রপ্তানিমুখী খেলনা উৎপাদনে এমন কারখানা বাংলাদেশে এটাই প্রথম।
কুমিল্লা ইপিজেডে গত ২৯ অক্টোবর এই কারখানা প্রথম আলোর পক্ষে সরেজমিনে যাওয়া হয়। ইপিজেডের ২১১ নম্বর প্লটে প্রায় দেড় বিঘা জমির ওপর তৈরি এই কারখানায় ৩০০ শ্রমিকসহ ৩৫০ জন কাজ করেন। ২০০-এর মতো নারী কর্মী আছেন। প্রশিক্ষণের জন্য ছয়জন চীনা প্রশিক্ষক আছেন।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি খেলনার চাহিদা সামনে রেখে কারখানা নির্মাণে বিনিয়োগেও আগ্রহী হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তারা। ইপিজেড ও এর বাইরে বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে।
মূলত জাপানের বাজার চাহিদার কথা মাথায় রেখে এই কারখানায় খেলনা তৈরি হয়। এ ছাড়া নামীদামি ব্র্যান্ড ও প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী খেলনাও তৈরি করে এই কারখানা। হাসি ব্র্যান্ডের মধ্যে ওফুরো সিরিজের একশ্রেণির খেলনার কথা জানা যায়, যেগুলো পানিতে ভাসে ও নানা রঙের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়। জাপানে বাথটাবে গোসল করার সংস্কৃতি জনপ্রিয় হওয়ায় ওফুরো সিরিজের খেলনাগুলোর প্রচলন বেশি। এসব খেলনার মধ্যে আছে রংবেরঙের হাঁস, ব্যাঙ, কচ্ছপ প্রভৃতি।
২০১৪ সালে মাত্র ৪২ হাজার মার্কিন ডলারের খেলনা রপ্তানি হয়। এরপর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত বাড়তে থাকে রপ্তানির খাতা। ২০১৫ সালে আড়াই লাখ ডলার এবং ২০১৬ সালে সাড়ে পাঁচ লাখ ডলারের খেলনা রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রায় নয় লাখ ডলারের খেলনা রপ্তানি হয়েছে। গত তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটির খেলনা রপ্তানি বেড়েছে ২১ গুণের বেশি।
কোম্পানির পরিচালক শোয়েব আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বমানের খেলনা রপ্তানি যে সম্ভব, সেটা প্রমাণ করেছে হাসি টাইগার। খেলনা কারখানা বেশ শ্রমঘন; এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি। বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
৫ বছরে রপ্তানি বেড়েছে ২০৭৫ গুণ
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের খেলনা রপ্তানির চিত্রটি বেশ আশাবাদী হওয়ার মতো। পাঁচ বছরের ব্যবধানে শিশুদের খেলনা রপ্তানি ২ হাজার ৭৫ গুণ বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৭ হাজার ৬৩৭ ডলারের খেলনা রপ্তানি হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খেলনাসামগ্রী রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ১২৬ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে কোনো পণ্য রপ্তানির এত বিকাশের নজির খুব বেশি নেই।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে খেলনা রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭০ লাখ ৩৫ হাজার ডলার। সেই হিসাবে, শুধু গত এক বছরের ব্যবধানে শিশুদের খেলনা রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩০ লাখ ৮০ হাজার ডলারের শিশু খেলনা। এর আগের বছর এই খাতে পরিমাণ ২২ লাখ ২০ হাজার ডলার।
বাংলাদেশ থেকে খেলনা রপ্তানির তালিকায় আছে ট্রাইসাইকেল, ইলেকট্রিক বা ব্যাটারিচালিত খেলনা গাড়ি, প্যাডেলচালিত গাড়ি, ইলেকট্রিক পুতুল, সাধারণ পুতুল ইত্যাদি। বাংলাদেশ থেকে যত খেলনা রপ্তানি হয়, এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি ট্রাইসাইকেল, স্কুটার, প্যাডেল কার, পুতুল ইত্যাদি। অবশ্য এসব খেলনার দামও তুলনামূলক বেশি।
ফ্রান্স, স্পেন ও জাপানই বড় বাজার
২০১৬-১৭ অর্থবছরে কোন কোন দেশে কত রপ্তানি হয়েছে, এর চূড়ান্ত হিসাব পাওয়া যায়নি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৪টি দেশে শিশু খেলনা রপ্তানি হয়েছে। ওই বছর মোট ৭০ লাখ ডলারের শিশু খেলনা রপ্তানি হলেও এর অর্ধেকই হয়েছে তিনটি দেশে। বাংলাদেশি খেলনা আমদানিতে শীর্ষ স্থানে আছে ফ্রান্স। দেশটি ওই বছর বাংলাদেশ থেকে ১৬ লাখ ডলারের খেলনা আমদানি করেছে। এরপরের স্থানে থাকা স্পেন নিয়েছে ১১ লাখ ৬৩ হাজার ডলারের খেলনা। আর জাপানে রপ্তানি হয়েছে ৯ লাখ ২৯ হাজার ডলারের খেলনা। বাংলাদেশ থেকে খেলনা আমদানির তালিকায় যেসব দেশ আছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাজ্য, ইতালি, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল। পাঁচ বছর আগেও এই তালিকা খুবই ছোট ছিল। ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র-মাত্র এই তিনটি দেশে খেলনা রপ্তানি হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের টয় অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবমতে, সারা বিশ্বে বছরে গড়ে নয় হাজার কোটি ডলারের খেলনা বেচাকেনা হয়। বাংলাদেশের খেলনার রপ্তানিবাজার মূলত ইউরোপ ও জাপানকেন্দ্রিক। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ইউরোপের বাজারে বছরে গড়ে ৭২০ কোটি ডলারের খেলনা রপ্তানি হয়।
খেলনা রপ্তানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে কর সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন ট্রাইসাইকেল, স্কুটার, প্যাডেল কার, পুতুল রপ্তানি করলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে আমদানি শুল্ক নেই। প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক খেলনার ওপর ৪ দশমিক ৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক আছে। আর জাপানের বাজারে শুল্ক নেই।
বাংলাদেশ থেকে খেলনার মতো একটি পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে, এটা খুবই ইতিবাচক একটি বিষয় বলেই মনে করছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, খেলনার একটি বড় বিশ্ববাজার রয়েছে, যার অধিকাংশ চীনের দখলে। এই বাজার ধরতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাঁদের পরিচালনায় মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য সরকারকে বাজার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম তৈরি, প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, খেলনা তৈরি একটি শ্রমঘন শিল্প। তৈরি পোশাকের মতো তাই এ শিল্পেও প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। আর খেলনার বিশ্ব বাজারের আকারও বিশাল। বাংলাদেশ খুব ছোট পরিসরে এ বাজারে প্রবেশ করেছে। মূলত, মজুরি বেড়ে যাওয়ায় চীনে খেলনা তৈরির খরচও এখন বেড়ে গেছে। এ কারণে বিদেশি খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের মতো দেশে কারখানা গড়তে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশে গত তিন বছরে তিনটি কারখানা গড়ে উঠেছে। আরও কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।