Published in সমকাল on Monday, 1 January 2018
অর্থনীতিতে ঝুঁকির বছর
শেখ আবদুল্লাহ
নতুন বছর মানেই নতুন আশা, নতুন চ্যালেঞ্জ। ২০১৭ সালের নানা অর্জনে নতুন বছরে প্রত্যাশাও অনেক। আগামী বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০১৮ সাল জুড়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলবে তার প্রস্তুতি। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা ২০১৮ সালকে অর্থনীতির জন্য ঝুঁকির বছর হিসেবে বিবেচনা করছেন।
সমকালের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালে দেশের অর্থনীতি কেমন যাবে বলে তারা ধারণা করছেন। তারা বলেছেন, নতুন বছরের অর্থনীতি নির্ভর করছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি কতটা শান্তিপূর্ণ হবে তার ওপর। রাজনীতিতে স্থিতিশীল পরিবেশ থাকলে ভবিষ্যৎ এক রকম, না থাকলে অন্যরকম। আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা ও শিল্পের জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ কতটা বাস্তবায়ন হবে, তাও অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির নিয়ামক হবে। এ ছাড়া পণ্য ও সেবামূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকার কতটা দক্ষতা দেখাতে পারবে, তার ওপর নির্ভর করবে বাজার পরিস্থিতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সমকালকে বলেন, ২০১৮ সাল গত কয়েক বছরের তুলনায় ভিন্ন। এ কারণে ভিন্ন যে, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০১৮ সাল নিবাচনের জন্য রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রস্তুত হবে কি-না তার ওপর নির্ভর করছে অর্থনীতি কেমন যাবে। যদি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ থাকে, তাহলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তর আরও ত্বরান্বিত হবে। আর যদি রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল হয় তাহলে অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গেল বছর চাল এবং পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি রোধে আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। নতুন বছরে সরকারকে এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। সাবেক এ গভর্নর আরও বলেন, ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক একটু নড়াচড়া করছে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে সহায়তা করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার-পাঁচ মাসের পরিসংখ্যান খুব বেশি সুখকর নয়। ব্যাংক খাতের দুরবস্থা স্পষ্ট। খেলাপি ঋণ ও অনিয়ম অনেক বেড়েছে। এ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা ২০১৮ সালে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, রফতানিতে কিছু প্রবৃদ্ধি থাকলেও তা ধরে রাখা সম্ভব হবে কি-না তা নিশ্চিত নয়। একই অবস্থা রেমিট্যান্সেও। যদিও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বেড়েছে, সে অনুযায়ী বিনিয়োগ হচ্ছে না। ঋণের অধিকাংশ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো চ্যালেঞ্জ। যদিও সরকার জমি প্রাপ্তি ও জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানোর কিছু উদ্যোগ নিয়েছে; কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নের গতি সন্তোষজনক নয়। ২০১৮ সালে এসব খাতে যে ব্যাপক গতি পাবে, সে আশাও করা যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে সুশাসন নিশ্চিত করা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করা চ্যালেঞ্জিং। এসবের সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ সালে নতুন মাত্রা যোগ করবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন থাকবে, তার ওপর নির্ভর করছে অন্যান্য খাতের গতি-প্রকৃতি। আইন-শৃঙ্খলা ও পরিবহন চলাচল পরিস্থিতি কী হবে, তার ওপর নির্ভর করবে অর্থনীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সব খাতেই সুশাসন নিশ্চিত করা দরকার। সম্প্রতি দুর্নীতি, অপচয় বেড়ে গেছে। ব্যাংক খাতে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও খেলাপি ঋণের চিত্র অত্যন্ত খারাপ। ব্যাংক খাত ঠিক করতে না পারলে প্রকৃত খাত এগোবে না।
চালের বাজারে একধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। এটা ব্যবস্থাপনার সংকট। চালের বাজারের প্রভাব পড়েছে অন্যান্য পণ্যেও। তিনি বলেন, উন্নয়ন হচ্ছে আবার বৈষম্যও বাড়ছে। এর অর্থ উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামাজিক উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে যাবে। সুষম উন্নয়নে নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনী বছর হওয়ায় একধরনের শঙ্কা থাকছেই। রাজনৈতিক অস্থিরতা কেউ আশা করে না। কিন্তু সরকার যথেষ্ট ভারসাম্য বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সে ঝুঁকি থেকেই যায়। আর তেমন কিছু হলে বিনিয়োগ কমবে, মূল্যস্ম্ফীতি বাড়বে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৮ সাল নির্বাচনের বছর। এ ছাড়া ২০১৭ সালের কিছু ঝুঁকি নিয়ে বছরটি শুরু হচ্ছে। বিশেষ করে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করা না গেলে এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বাড়বে। তিনি বলেন, খাদ্য মূল্যস্ম্ফীতির ঝুঁকি রয়েছে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বোরো মৌসুম পর্যন্ত পর্যাপ্ত মজুদ রাখতে হবে, যাতে বাজারে হস্তক্ষেপ করা যায়। এ ছাড়া বড় বড় অবকাঠামোর সময়মতো ও সাশ্রয়ী বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জের উত্তরণ নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। সমঝোতা, অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করা গেলেই এ চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণ সম্ভব।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ২০১৮ সাল নির্বাচনের বছর। নির্বাচনের বছরে ব্যবসায়ীরা শঙ্কার মধ্যে থাকেন। ১৯৯৬ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনের বছরই রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বছর কেমন যাবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে শঙ্কার বাইরে নেই ব্যবসায়ীরা। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিনিয়োগ ও ব্যবসার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা জ্বালানি সংকট। সরকার ২০১৮ সালে এলএনজি সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে। সময়মতো সরবরাহ হবে কি-না, হলে তার মূল্য কী হবে এসবও ব্যবসায়ীরা দেখার অপেক্ষায় আছেন।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, ২০১৮ নির্বাচনের বছর। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপীই নির্বাচনের বছরে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগে কিছুটা শ্নথগতি থাকে। অতীতে বাংলাদেশে নির্বাচনের বছরে অস্থিরতা দেখা গেছে। যদিও গত কয়েক বছর তা নেই। তারপরও ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা সতর্ক থাকবেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে সরকার যদি বছরের শুরুতেই সবাইকে নিয়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ স্পষ্ট করতে পারে, তাহলে ঝুঁকি কমবে।