Published in প্রথম আলো on Saturday, 24 March 2018
প্রযুক্তি ও কর্মসংস্থান
মধ্যম সারির কর্মীদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি বেশি
প্রতীক বর্ধন
চারদিকে প্রযুক্তির জয়জয়কার। আমরা শুনতে পাচ্ছি, অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের কাজ রোবট দিয়ে করানো হবে। ফলে তাঁরা দলে দলে চাকরি হারাবেন। কথাটা পুরোপুরি ঠিক না হলেও আংশিকভাবে ঠিক। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) তথ্যানুসারে, ধনী দেশগুলোতে নিম্ন দক্ষতার শ্রমিকেরা খুব বেশি চাকরি হারাননি। ১৯৯৫-২০১৫ কালপর্বে কেবল স্লোভেনিয়া, হাঙ্গেরি ও চেক রিপাবলিকে নিম্ন দক্ষতার শ্রমিকেরা কাজ হারিয়েছেন। কিন্তু সব ধনী দেশেই মাঝারি দক্ষতার কর্মী বা শ্রমিকেরা কাজ হারিয়েছেন। এই তালিকায় সবার ওপরে আছে অস্ট্রিয়া। সেখানে এই কালপর্বে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ মাঝারি দক্ষতার কর্মী/শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। সবার নিচে আছে চেক রিপাবলিক, সেখানে কাজ হারিয়েছেন ২ দশমিক ১ শতাংশ কর্মী/শ্রমিক। সামগ্রিকভাবে ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে ১৯৯৫ সালে মাঝারি দক্ষতার শ্রমিকের হার ছিল ৪৯ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪০ শতাংশের নিচে।
ব্যাপারটা হলো, খুবই কাঠামোবদ্ধ ও নিরাপদ পরিবেশে শারীরিক শ্রম এবং তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার কাজে নিয়োজিত মানুষেরা অটোমেশন বা স্বতশ্চলীকরণের কারণে চাকরি খোয়ানোর ঝুঁকিতে আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এসব কাজেই ৫১ শতাংশ কর্মী নিয়োজিত, যাঁদের সম্মিলিত বার্ষিক মজুরি ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার (২.৭ ট্রিলিয়ন)। অর্থাৎ যে ধরনের কাজ কিছু নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের মাধ্যমে করা সম্ভব এবং যার জন্য তেমন একটা জটিল চিন্তার প্রয়োজন হয় না, যেমন কারখানার যন্ত্রচালক ও কেরানি, এই প্রকৃতির মানুষদের চাকরি খোয়ানোর আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক গবেষকেরা দেখেছেন, রোবট মানুষের জন্য কঠিন কাজগুলো অনায়াসে করতে পারলেও সহজ কাজগুলো তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। ব্যাপারটা খুব সাধারণ উদাহরণ দিয়েই বোঝানো যায়। সেটা হলো সুপার কম্পিউটার হয়তো বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে দিতে পারে। কিন্তু দাবা খেলার পর ঘুঁটিগুলো গুছিয়ে রাখার ক্ষমতা রোবটের নেই। উপলব্ধি বা বিমূর্ত কল্পনা ও সচলতার দিক দিয়ে রোবট এখনো মানুষের সমকক্ষ নয়। অন্যদিকে উচ্চপর্যায়ের চিন্তা বা যুক্তির জন্য খুব বেশি গণনার প্রয়োজন হয় না। বরং নিম্নপর্যায়ের কাজের জন্য বেশি গণনার প্রয়োজন হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে দেশটিতে যে ১০টি পেশায় সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হচ্ছে, তার বার্ষিক গড় মজুরি ৩২ হাজার ডলার। অন্যদিকে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন চাকরির চাহিদাও বাড়ছে, যার গড় মজুরি বছরে এক লাখ ডলার। কিন্তু মধ্যম সারির চাকরি বাড়ছে না।
আমাদের দেশে অটোমেশন বা স্বতশ্চলীকরণ অতটা বেশি না হলেও বস্ত্র কারখানাগুলোতে ইতিমধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। সেটা হলো টেক্সটাইল কারখানাগুলোতে এমন ধরনের যন্ত্র চলে এসেছে, যা চালানোর জন্য মেশিন অপারেটরদের প্রয়োজন নেই। বরং তার জায়গায় প্রকৌশলীরা সেই যন্ত্রে নির্দেশনা দিয়ে কাজ সারছেন। কারখানার ওসব জায়গায় শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। ফলে আগেকার মেশিন অপারেটরদের হয় উচ্চতর দক্ষতা অর্জন করতে হবে, না হয় তাঁদের শ্রমিকের কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক এ কারণে যে আমাদের তরুণদের সিংহভাগই মাঝারি দক্ষতাসম্পন্ন। উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। আবার এই প্রযুক্তির বিকাশের কারণে অনেক উন্নত দেশের কোম্পানিগুলো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে কারখানা সরিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না। আমাদের বাণিজ্যও সে হারে বাড়ছে না। তাই দেশে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাত্রা খুবই কম। এ অবস্থায় আমাদের তরুণদের পক্ষে উচ্চ দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ কম। এক তথ্যপ্রযুক্তি খাত ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে এই সুযোগ খুবই সীমিত।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, দেশের ৪৭ শতাংশ কাজ স্বতশ্চলীকরণের আওতায় আসার আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাতে এটি বেশি হবে। তিনি আরও বলেন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পোশাক কারখানা পুরোপুরি স্বতশ্চলীকরণের আওতায় এলে সীবক বা যাঁরা সেলাই করেন, তাঁদের মধ্যে ৯৯ শতাংশের চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এ ছাড়া যাঁরা ব্লিচিং করেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি আরও বলেন, উদ্ভাবনমূলক বা সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষের চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে কম। আর মাঝারি দক্ষতার মানুষের চাকরি খোয়ানোর ঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এতে আমাদের পক্ষে জনসংখ্যা ডিভিডেন্ডের সুযোগ নেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।’
সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমেও স্বতশ্চলীকরণ শুরু হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অনেক সংবাদপত্রে এখন সফটওয়্যার ব্যবহার করে টেমপ্লেট-জাতীয় প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে উইকিলিকস যেভাবে তথ্যের ভান্ডার উপুড় করে দিতে শুরু করেছে বা যেভাবে পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসের মতো ফাঁসকাণ্ড ঘটছে, তাতে সাংবাদিকদের তথ্য বিশ্লেষণের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। অন্যদিকে দেশেসহ পৃথিবীর নানা জায়গায় প্রথাগত পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ যেভাবে কঠিন হয়ে উঠছে, তাতে সাংবাদিকতা প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ ও হ্যাকিংয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, এমন ধারণা অমূলক নয়। অন্যদিকে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে গণমাধ্যমকে আরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। তবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা অনুসারে নিকট ভবিষ্যতে স্বতশ্চলীকরণের কারণে সাংবাদিকদের চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা কম। বরং নৈমিত্তিক কাজগুলো সফটওয়্যার করে দিলে সাংবাদিকেরা অনুসন্ধানী কাজে আরও মনোযোগী হতে পারবেন।
কিছুদিন আগে নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান ভারত সফর করে গেলেন। তিনি বলেছেন, ভারত আর বেশি দিন আউটসোর্সিংয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারবে না। স্বতশ্চলীকরণের ফলে অনেক কাজই তখন সফটওয়্যার দিয়ে করানো সম্ভব হবে, পশ্চিমারা যা এত দিন আমাদের মতো দেশে আউটসোর্সিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দিত। ফলে এই আউটসোর্সিং শিল্প নিয়ে আমরা যত উচ্চাশা পোষণ করি না কেন, এ দিয়ে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই ক্রুগম্যান উৎপাদনশীল খাতের ওপর বেশি জোর দিতে বলেছেন। এখনো অনেক পণ্যের দরকার আমাদের জীবনে আছে, যেগুলো বাজারে পাওয়া যায় না। বাজার যাচাই করে সেগুলো উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে হবে।