Published in প্রথম আলো on Sunday 23 June 2019
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নতুন বাজেটের বিভিন্ন দিক, নানাজনের প্রতিক্রিয়া, বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও অর্থনীতির সামনের দিনগুলোর নানা দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শওকত হোসেন ও প্রতীক বর্ধন।
প্রথম আলো: সরকার টানা ১১তম বাজেট দিল। এক সরকার কখনো এতগুলো বাজেট টানা দেয়নি। নিশ্চয়ই এর একটি বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই বাজেট সম্পর্কে কী বলবেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এটি যেমন ধারাবাহিকতার বাজেট, তেমনি নবসূচনারও বাজেট। এর আগে একই শাসক দলের অধীনে এতগুলো বাজেট আমরা দেখিনি। এবারের বাজেটের অভিনব ব্যাপারটা হলো, এটি যেমন নতুন সরকারের প্রথম বাজেট, তেমনি নতুন অর্থমন্ত্রীরও প্রথম বাজেট। আশা করেছিলাম, নতুন অর্থমন্ত্রী নিজের ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যের ছাপ রাখবেন। নীতিকাঠামোর ক্ষেত্রেও এতে একটি সন্ধিক্ষণ আছে: সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছর এটি, আছে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার, অন্যদিকে ২০১৫ সালে সরকার বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে স্বাক্ষর করে এসেছে। আবার একটি ছেদবিন্দুও আছে। এই দুইয়ের সম্মিলনেই আমরা বাজেট দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা রক্ষিত হলো, অভিনবত্ব পিছিয়ে গেল।
অভিনবত্বে মার খাওয়ার ব্যাপারটা হলো এ রকম যে আমরা ভেবেছিলাম, সম্প্রতি অর্থনীতিতে যেসব চাপ সৃষ্টি হয়েছে, বাজেটে তার একটি স্বীকারোক্তি থাকবে এবং তা মোকাবিলার কৌশল থাকবে। আর সেই কৌশল রাজস্ব আদায় আর বরাদ্দ দেওয়ার মধ্যে সীমিত থাকবে না। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য রাজস্ব আদায় ছাড়া যেসব প্রচলিত কৌশল আছে, তা ব্যবহার করা হবে। যেমন টাকার বিনিময় হার নির্ধারণ, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাজারমূল্য, খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা, রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব বাধ্যবাধকতার মধ্যে কাজ করতে হয়, সেগুলো নির্ধারণ করা বা স্থানীয় সরকারকে আরও বড় পরিসরে ব্যবহার করা—এসব কৌশল একত্র করার চেষ্টা দেখলাম না। প্রস্তাবিত বাজেট শেষমেশ বরাদ্দের মধ্যেই সীমিত হয়ে গেল। চাপটা রাজস্বের ওপরই পড়ল। অথচ বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে কম রাজস্ব আদায়কারী দেশগুলোর একটি।
অভিজ্ঞতা বলছে, বাংলাদেশের বর্তমান কাঠামোর মধ্যে যেটুকু করার ছিল, গত ১০ বছরে তা করা হয়ে গেছে। বলা যায়, প্রায় নিঃশেষিত হয়ে গেছে। আমরা এই কাঠামোর মধ্যে আটকে গেছি। অর্থাৎ, ২৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় হবে না, আর বাজেট বাস্তবায়িত হবে ৮০ শতাংশের মতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পার্থক্য বাড়ছে। অর্থাৎ প্রথমত, বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতাগুলো স্বীকার করা হলো না; দ্বিতীয়ত, সামষ্টিক অর্থনীতির কৌশল ঠিক করা হলো না; তৃতীয়ত, সংস্কারের পথে যাওয়া হলো না। ব্যাংক খাত, স্থানীয় সরকারের সংস্কার তো দূরের কথা, আমার গ্রাম, আমার শহরের মতো কর্মসূচি দিয়ে যে সমাজভিত্তিক অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতির বীজ উপ্ত হতে পারত, তা-ও হলো না।
একই সঙ্গে বাজেটটি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সঙ্গে যুক্ত হলো না। মনে হয়, পরিকল্পনা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যে সমন্বয় দরকার, তা নেই। পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন—এদের মধ্যে যে আন্ত ও অন্ত সমন্বয় দরকার, তা নেই।
প্রথম আলো: বর্তমান অর্থমন্ত্রী তো পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। ফলে আরও জোরালো সমন্বয় আশা করাটা কি বাতুলতা? আর ব্যক্তিবদলের ছাপ অর্থনীতিতে পড়ে না কেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: শাহ এ এম এস কিবরিয়া কিংবা সাইফুর রহমানের আমলে অর্থনৈতিক বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা ছিল। এই ভূমিকা গত ১০ বছরে ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই তা এখন উচ্চপর্যায় থেকে পরিচালিত হচ্ছে। অনেক সময় আবার পরিচালনা কেন্দ্র অদৃশ্য থেকেছে। আগের অর্থমন্ত্রীরা একটি প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করতেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক উপদেষ্টা থাকতেন। এখন অর্থমন্ত্রীর ভূমিকা ম্লান হওয়ার পাশাপাশি পেশাজীবীদের ভূমিকাও সংকুচিত হলো। এমনকি জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও ম্লান। বাজেট আমলানির্ভর হয়ে গেল। বিভিন্ন স্তর থেকে উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে এসে কীভাবে বাজেটে যুক্ত করা যায়, সেই চেষ্টা অর্থমন্ত্রী করেননি। অর্থমন্ত্রী অবয়বের দিকে যতটা নজর দিয়েছেন, অন্তরের দিকে ততটা দেননি।
প্রথম আলো: তাহলে সরকারের কী করার ছিল? আবার অনেকেই বলেন, অর্থনীতি তো ভালোই আছে, সমস্যা কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বাংলাদেশ তুলনীয় দেশগুলোর চেয়ে প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ে ভালো করছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ কি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে ভালো করছে? যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে? পুঁজিবাজারে ভালো করেছে? গরিব মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যে ভালো করেছে কি? তাই গড় দিয়ে বিচার করা কতটা ভালো হবে? যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক সংকট শুরুর আগের দিন পর্যন্ত মার্কিন সরকার বলেছে, এর চেয়ে ভালো অর্থনীতি আর নেই। সবচেয়ে ভালো অর্থনীতিরও কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। বিপর্যয় যেদিন ঘটে, সেদিনই বোঝা যায়। আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির যে চলমান কিংবদন্তি, তা যেন আগামী দিনে তার উন্নয়নের শত্রু না হয়ে যায়।
সবকিছুরই একটা ব্যবহারজনিত ক্ষয় থাকে। বাংলাদেশেরও ১০ বছর ধরে যে ধারা চলে আসছে, তারও আছে। এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নয়নের ধারার সঠিকতা, স্থায়িত্ব ও ফলাফল নিয়ে আলোচনার সময় এসেছে। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ এই হারে বাড়িয়ে ব্যক্তি বিনিয়োগের অভাব পূরণ করাটা স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। বিমানকে তো দুটি ইঞ্জিন নিয়ে চলতে হয়। কিন্তু আমরা একটি ইঞ্জিন দিয়ে চলছি। আমাদের ধারণা ছিল, ব্যবসার ব্যয় কমালে বা সুদের হার কমালে ব্যক্তি খাত উৎসাহিত হবে। পুঁজিবাজারে প্রণোদনা দিলে ভালো বিনিয়োগ আসবে। কিন্তু তা হয়নি।
একসময় দেশে খাদ্যের দুর্ভিক্ষ ছিল। এরপর আমরা অবকাঠামোর দুর্ভিক্ষ দেখলাম। এটি কাটানোর জন্য বিদ্যুৎ, রাস্তা নির্মাণসহ নানা বড় প্রকল্প করতে শুরু করলাম। দেখা গেল, ১ হাজার টাকার জিনিস হাজার টাকায় উঠে গেল এবং তা যেন শেষ আর হয় না। আর এগুলো অভ্যন্তরীণ অর্থায়নে হওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে চাপ সৃষ্টি হলো। এতে এত টাকা চলে গেল যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ আর বাড়ানো গেল না। ফলে আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এত বেশি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম যে এটি যে আদতে আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রাগৈতিহাসিক ধারণা, তা ভুলে গেলাম।
অন্যদিকে আমাদের ঋণ বাড়ছে। বড় ঋণের স্বচ্ছতা নেই। ফলে দায়দেনা পরিশোধের টেকসই পরিস্থিতি আছে কি না, সেটা দেখাটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বরাদ্দের ক্ষেত্রে বলতে হয়, পাঁচটি খাত ৭০ ভাগ নিয়ে যাচ্ছে আর বাকি ১২টি খাত ৩০ শতাংশ। এর মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে—সেই ২ ও ১ শতাংশেই আটকা পড়ে রইলাম আমরা। অর্থনীতির ভাষায় বলতে হয়, সরকারের আন্তখাত ভারসাম্য রাখতে হবে। অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও তো দক্ষ মানবসম্পদ লাগবে, শিক্ষায় এই বরাদ্দ দিয়ে তো সেটা করা যাবে না।
অন্যদিকে অবকাঠামো ও রপ্তানি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে আমরা কৃষিকে অবহেলা করলাম। পুরো বাণিজ্য শর্ত কৃষকের বিরুদ্ধে চলে গেছে। কৃষির যথেষ্ট যন্ত্রীকরণ না হওয়ায় উৎপাদনশীলতা কমেছে। কিন্তু তাতে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা কমেনি। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণেও কৃষি অবহেলিত হচ্ছে। ব্যাপারটা হলো, তৈরি পোশাক খাতের প্রতিনিধিরা যে রকম শক্তিশালী সংগঠন নিয়ে দর-কষাকষি করতে পারেন, কৃষক তা পারেন না। তাঁর সেই অভিন্ন প্রতিনিধিও নেই। সামাজিকভাবেও কেন যেন কৃষকেরা হারিয়ে গেছেন। কৃষি নিয়ে গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে যে পরিমাণ গবেষণা হতো, এখন তার লেশমাত্র নেই। সবাই শিল্পায়ন, অবকাঠামো ও রপ্তানি নিয়ে আলোচনা করে।
প্রান্তিক মানুষের কথাও গড় চিন্তার মধ্যে কোথাও নেই। জেন্ডার বাজেট, প্রবীণ বাজেট, শিশু বাজেট—সবই আছে, কিন্তু এই বাজেট কতটা বাস্তবায়িত হলো, তা পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা নেই। যদিও এবার কিছুটা হয়েছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বোর্ডকে দেওয়া সরকারের সহায়তা একদম কমে গেছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী, শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষের জন্য কিছু রাজস্ব পদক্ষেপ ছাড়া কিছু নেই। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, হাওর অঞ্চলের মানুষ—এদের জন্য কিছু নেই। এসব কথার পরোক্ষ প্রতিফলন নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। কিন্তু বাজেটে নেই। তবে ইশতেহারকে আমরা ভিত্তি ধরতে চাই।
আমরা যে রাজনীতির কথা বলি আর যে অর্থনীতির চর্চা করি, তার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে। বিচ্ছিন্নতা। যে রাজনীতি অর্থনীতির দ্বন্দ্ব ধারণ করে না, সেই রাজনীতি টেকসই হবে না। বাংলাদেশের ইতিহাস তা-ই বলে। তবে এই দুটোকে সংযুক্ত রাখতে পারত জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কার্যকর গণতন্ত্র।
প্রথম আলো: সরকার তো সমস্যার কথা স্বীকারই করছে না, বরং তার মধ্যে অস্বীকৃতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তো এর সমাধান কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: রাজনীতিবিদেরা অনেক সময় দুই স্তরে কথা বলে থাকেন। একটি কথা বলেন ভোটার ও নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে, ঘরে গিয়ে তাঁরা এর যৌক্তিকতা বুঝে সমাধানের চেষ্টা করেন। ব্যাপারটা যদি এ রকম হয়, তাহলে চিন্তা নেই। কিন্তু তাঁরা যদি ঘরে গিয়েও তা বিশ্বাস করেন, তাহলে দুশ্চিন্তার কারণ আছে। তাহলে অস্বীকৃতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কিন্তু অর্থনীতি নিজের গতিতেই চলবে। ব্যাংকের তারল্য চাহিদা পূরণের জায়গায় নেই, এ কথা অস্বীকার করে লাভ কী। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি শিক্ষা যাচ্ছে না। সেই জায়গা নিয়েছে মাদ্রাসাশিক্ষা। এসব অস্বীকার করে লাভ নেই। তাদের বুঝতে হবে, এসব সমস্যা সমাধান করলে আগামী ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যেতে পারে। রেহমান সোবহানকে উদ্ধৃত করে বলতে চাই, ‘আমার সমালোচক, আমার বন্ধু’। গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া দেশের উন্নতি আমরা সবাই চাই। কেউ কারও চেয়ে দেশকে কম ভালোবাসে না। আর সমালোচনাকে সম্মানের সঙ্গে অনুধাবন করতে হবে।
প্রথম আলো: বাজেটের ভালো দিক কী কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ভালো দিক অনেকই আছে। রাজস্ব আয়-ব্যয় কাঠামোতে বাস্তবতা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৯-২০-এর প্রাক্কলনগুলো ২০১৮-১৯-এর নিচে, দেশজ আয়ের অনুপাতে। ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিদেশি সাহায্য ব্যবহারের চেষ্টা ইতিবাচক মনে করি। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর চেষ্টা ইতিবাচক। ভ্যাট আইনে স্তর অনেক বেশি থাকলেও তা চালু করা হয়েছে। তা-ও ঠিক আছে। বরাদ্দের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক দিক আছে। যুবকদের জন্য তেমন কোনো কর্মসূচি না থাকলেও তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে। তবে এই সংখ্যা নিয়ে একটু সমস্যা আছে। এ ছাড়া জমি বিক্রি, বিদ্যুতের লাইনসহ নানা কাজে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে—প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ব্যবসায়িক ভাড়ার ক্ষেত্রে ভ্যাট অতিরিক্ত অঙ্ক হিসেবে ভাড়াটে দেবেন, নাকি বিদ্যমান ভাড়া থেকে কেটে নেওয়া হবে, এ নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে।
প্রথম আলো: এবারের বাজেটকে আপনারা অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগীদের বাজেট বলছেন। এটি কি নির্বাচনের ধরনের কারণে নতুন এক সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছে? আবার এবার কি বাজেট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বেশি হচ্ছে?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বাজেটকে কেন্দ্র করে মানুষ জমে থাকা ক্ষোভ বা হতাশা প্রকাশ করেছে কি না, আমরা জানি না, এ নিয়ে গবেষণা নেই। তবে আমাদের প্রতিক্রিয়ার কারণ হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহার। ইশতেহার দেখে আমাদের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। নতুন অর্থমন্ত্রী এসেছেন, সেটিও একটি কারণ। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন কথায় আমাদের আস্থা তৈরি হয়েছিল। মনে হয়েছিল, তাঁরা দিনবদল বা পরিবর্তন চান। কিন্তু না বদলানো মানুষের কাছে তাঁরা জিম্মি হয়ে থাকছেন। এসব মানুষই ঋণ খেলাপ করছে, কর দিচ্ছে না, বিদেশে টাকা পাচার করছে, সরকারি প্রকল্পের ব্যয় বাড়াচ্ছে, নানা অপকর্ম করছে। সরকার এসব মানুষের পক্ষে কেন দাঁড়াবে? রাজনীতির অ আ ক খ দিয়ে এটি মেলানো যায়
না। অথচ আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিকভাবে কৃষক, ছোট উৎপাদক, বিকাশমান মধ্যবিত্ত ও পেশাজীবীদের পক্ষের দল ছিল। এখন কি তাহলে এই দলের শ্রেণিভিত্তি বদলে গেল? আবার এই দলের অর্থনৈতিক কর্মসূচি জনবান্ধব, বাস্তবায়ন মানুষের প্রতিকূলে—এই দ্বন্দ্বের সমাধান কীভাবে হবে? প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার মধ্য দিয়ে এই আলোচনা উঠে না এলে এই দ্বন্দ্বের নিরসন হবে না। তাহলে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপনের ভিত টেকসই হবে না। ২০৪১ তো দূরের কথা।
প্রথম আলো: সামনের ১০ বছরকে দৃষ্টিতে রেখে এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের উত্তরণের পথ কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আসছে। গতানুগতিকভাবে অর্থনীতিবিদদের প্যানেল তৈরি না করে বিভিন্ন পেশার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বহুপক্ষীয় কমিটি গঠন করে গত ১০ বছরের সফলতার মূল্যায়ন করা উচিত। তাঁদের কাজ হবে, অর্জিত সফলতা কীভাবে টেকসই করা যায় এবং এর ফলে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তা সমাধানের পথ বাতলানো। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নির্মোহভাবে এই কাজ করতে হবে। আর সে সময় সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ও এসডিজি সামনে রাখতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে আমরা সেই অর্থে সুযোগ হিসেবে নিতে পারি। এটির উদ্দেশ্য দোষ খোঁজা নয়, সফলতাকে টেকসই করার জন্য। সরকার যতটা চাইবে, নেবে; সবটা নিতে হবে, তেমন নয়। দলীয় চিন্তা থেকে নয়, জাতীয় চিন্তা থেকে এটা করতে হবে। সমমনা মানুষ নয়, বৈচিত্র্যপূর্ণ চিন্তার সমাবেশ ঘটাতে হবে এতে। এটা এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে অসহিষ্ণু মনোভাবের কারণে সব ধাক্কা খাচ্ছে। আমরা অর্থনৈতিক যুক্তি দিয়েই এসব বলছি। কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তা বিচার করা হচ্ছে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ধন্যবাদ।