পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বাজারে আমাদের আরো বড় পরিসরে ঢুকতে হবে: মোস্তাফিজুর রহমান

Published in কালের কন্ঠ on ThursdayJanuary 2020

অধরা হয়ে পড়ছে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য

ধারাবাহিকভাবে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ফলে চলতি অর্থবছরের শেষে দেশের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এরই মধ্যে সরকার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করেছে। এর পরও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে। কেননা রপ্তানি আয় ইতিবাচক ধারায় নিয়ে যেতে হলে আগামী ছয় মাস, ১২ থেকে ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করতে হবে।

তাঁরা আরো জানান, ডলারের বিপরীতে টাকার শক্ত অবস্থান এবং পণ্য বহুমুখীকরণে পিছিয়ে থাকায় পোশাক রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে। ফলে প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছে ব্যবসা হারাতে বসছে। এ জন্য শুধু প্রণোদনায় নয়, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে, পণ্য বৈচিত্র্য আনতে হবে, এ ছাড়া বন্দর, পরিবহন এবং ব্যবসার পরিবেশ আরো উন্নত করতে হবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি দিয়েই ২০১৯-২০ অর্থবছরের রপ্তানি শুরু হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পোশাক খাত থেকে আয় হয় ৩৩১ কোটি ডলার আর এ সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯.৭ শতাংশ। কিন্তু পরের মাস থেকে শুরু হয় ভাটার টান। ডিসেম্বর ছাড়া বাকি চার মাসই কমেছে রপ্তানি আয়। অন্য মাসগুলোর মধ্যে আগস্টে প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে ৮ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৮.৪৭, অক্টোবরে ১৯.৭৪ এবং নভেম্বরে কম হয়েছে ১১.৯ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ গেছে অক্টোবরে। সব মিলিয়ে গত জুলাই-ডিসেম্বরে পোশাক খাতে রপ্তানি আয় হয়েছে এক হাজার ৭০৮ কোটি ডলার। এই আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.২১ শতাংশ কম।

বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্রেতারা এখন আর কোনো এক দেশ থেকে পণ্য কিনতে চায় না, ফলে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। এর প্রভাবে গত এক বছরে কটন টি-শার্ট রপ্তানিতে ২৩ মিলিয়ন ডলারের আয় হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই ব্যবসা গেছে শ্রীলঙ্কায় ছয় মিলিয়ন, ভিয়েতনামে আট মিলিয়ন, এমনকি পাকিস্তানেও গেছে দুই মিলিয়ন। ওদিকে কম্বোডিয়ায় গেছে চার মিলিয়ন। আয় কমেছে ওভেন পোশাকেও।’

রপ্তানি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ওভেন পোশাকে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আয় কম হয়েছে ৭.২৮ শতাংশ। এ সময় আয় হয়েছে ৭৮১ কোটি ডলার। নিট পোশাকে আয় কমেছে ৫.১৬ শতাংশ। এ আয় হয়েছে ৮২০ কোটি ডলার।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পোশাক খাতের রিটেনশনের ওপর পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রুবানা হক বলেন, ‘এর ফলে আমদানিতে যেমন ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না, একই সঙ্গে দেশের টাকা দেশেই থেকে যাবে। আর এই টাকা দিয়ে কারখানার শ্রমিকদের মজুরি, অফিস ও কারখানার খরচ চালাতে পারি। এ জন্য সরকারের দ্রুত নীতিসহায়তা দরকার।’

দেশের রপ্তানি আয় ডলারের রিপরীতে টাকার শক্ত অবস্থান আর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে উল্লেখ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলো এমন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা বাংলাদেশ নিতে পারেনি। তারা তাদের মুদ্রামানের অবমূল্যায়ন দ্রুত হারে করেছে। আমরাও কিছুটা করেছি। কিন্তু অন্যরা যে হারে করেছে সেটা আমরা সামাল দিতে পারিনি। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হলে আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে রপ্তানি কাঠামো পরিবর্তন করে আরো মূল্য সংযোজন করতে হবে। পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বাজারে আমাদের আরো বড় পরিসরে ঢুকতে হবে। এ অবস্থায় পরের ছয় মাসে পোশাক খাতের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে দুই হাজার ১১২ কোটি ডলারের রপ্তানি করতে হবে, যা অনেকটা অসম্ভব বলে মনে করছেন এই বিশ্লেষক।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বড়দিন উপলক্ষে পোশাকের বড় একটা চাহিদা থাকে। সেখানেও আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। সুতরাং এটি একটি অশনিসংকেত। জানুয়ারিতে কিছু একটা বাড়বে। সেটাকে কাটিয়ে একটা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে যাওয়াটা বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা আগামী মাসগুলোতে আমাদের ১২-১৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি করতে হবে। কেননা গত ছয় মাস আমাদের প্রায় ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। তৈরি পোশাক আয়ের এমন নাজুক প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক রপ্তানি আয়ে। জুলাই-ডিসেম্বরে দেশের রপ্তানি আয় হয়েছে এক হাজার ৯৩০ কোটি ডলার। এটা গত অর্থবছরের চেয়ে ৫.৮৪ শতাংশ কম।

প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হলে আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে রপ্তানি কাঠামো পরিবর্তন করে আরো মূল্য সংযোজন করতে হবে। পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বাজারে আমাদের আরো বড় পরিসরে ঢুকতে হবে। এ অবস্থায় আগামী ছয় মাসে পোশাক খাতের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে দুই হাজার ১১২ কোটি ডলারের রপ্তানি করতে হবে, যা অনেকটা অসম্ভব।

 

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির বিশেষ ফেলো