Published in বণিকবার্তা on Tuesday 2 June 2020
আইসিএমএবির বাজেট-পূর্ববর্তী বিশ্লেষণ
করমুক্ত আয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে ৪ লাখ করার প্রস্তাব
টিকে থাকাই এ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও সামাজিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী করে তোলার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করাই বাজেটের লক্ষ্য হওয়া উচিত। দি ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) আয়োজিত বাজেট-পূর্ববর্তী বিশ্লেষণের ওয়েবিনারে এমন মতামত রেখেছেন দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষক ও ব্যক্তিত্বরা। এছাড়া চলমান নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়ের পরিমাণ ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে সর্বনিম্ন ৪ লাখ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি আয়োজিত এ ওয়েবিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, এনবিআর চেয়ারম্যান এবং সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন সিদ্দিকী এবং এনবিআর সদস্য রঞ্জন কুমার ভৌমিক (ট্যাক্স সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন) মূল আলোচক হিসেবে অংশ নেন। এছাড়া এতে অংশ নেন লংকাবাংলা ফিন্যান্স লিমিটেডের এসইভিপি এবং হেড অব অপারেশন এ কে এম কামরুজ্জামান। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ফিন্যান্স বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম।
আইসিএমএবি প্রেসিডেন্ট মো. জসিম উদ্দিন আকন্দ অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য সর্বস্তরের সবারই নিজেদের জায়গা থেকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। পেশাদার হিসাববিজ্ঞানীদের সংগঠন হিসেবে বাজেটসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের প্রতি নীতিগত প্রস্তাব এবং পরামর্শ প্রদান আইসিএমএবির একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। রাজস্ব আহরণ ও বৃদ্ধি এবং সরকারের বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের বিষয়ে স্বচ্ছতা সৃষ্টিতে সিএমএ পেশাদাররা বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদ রাখেন।
আইসিএমএবি ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মামুনুর রশীদ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে জাতীয় বাজেট ২০২০-২১-এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবসম্পৃক্ত একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৩টি মূল প্রস্তাবসমৃদ্ধ এই পত্রে কোম্পানি রিটার্নের সঙ্গে ‘কস্ট স্টেটমেন্ট অ্যাকোম্পানিড বাই কোয়ান্টিটেটিভ অ্যানালাইসিস স্টেটমেন্টস কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএমএ) কর্তৃক নিরীক্ষাকৃত সনদ’ সংযোজনের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। চলমান পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়ের পরিমাণ ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে সর্বনিম্ন ৪ লাখ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এরই সঙ্গে খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষিনিরাপত্তা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা, জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা, শিল্পায়ন ও পুুঁজি বাজার উন্নয়ন, গার্মেন্টস সেক্টরে বিশেষ সুবিধা প্রদান, পরিবহন ও বিমান শিল্পে বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য বাজেটে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয় এই প্রস্তাবপত্রে।
মো. মামুনুর রশীদ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে একে শক্তিশালী করে তোলার প্রতি জোর দেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে নতুন করে সাজাতে হবে, যাতে করে চলমান সংকট এবং ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির যথাসম্ভব মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান সরকারের প্রতিটি খাতে ব্যয়ের মান নিরূপণে নিরীক্ষণ বা অডিট প্রক্রিয়াকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন। বিশ্বব্যাপী চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতির আলোকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতকে যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, এ বছরের বাজেটকে আমি বলব হেলথ বাজেট, এটি আমাদের বেঁচে থাকার বাজেট। আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়েও যথাযথ গুরুত্ব প্রদান এবং এ প্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে পালনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরির পরামর্শ দেন তিনি। চলতি বছরের বাজেটকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং এই চলমান সংকটকে মোকাবেলা করে টিকে থাকার বাজেট হিসেবে উল্লেখ করতে চান তিনি। এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ক্ষতিও মোকাবেলা করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিষয়ে অনেক দায়িত্ব পালন করার বিষয়ে তিনি বলেন, ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম প্রণয়ন করা হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
এনবিআর চেয়ারম্যান এবং সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, বিভিন্ন খাতে আমাদের কিছু ব্যয় হয়, যেগুলো একেবারেই প্রয়োজনীয় নয়। এ ধরনের ব্যয়গুলো যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলতে হবে। স্বাস্থ্য খাত এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ব্যয় বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তিনিও। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য যেসব খাত বন্ধ থেকেছে, এগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে। যাতে করে এগুলো টিকে থাকতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ বছরের বাজেট অন্যান্য যেকোনো সময়ের বাজেটের চেয়ে ভিন্ন। এবারের বাজেটের নিরূপণ হওয়া উচিত স্বাস্থ্য, মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটকে সামনে রেখে। এই বিষয়গুলো এই সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম সঞ্চালনার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে উদ্ভূত বেকারত্ব সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে এ পরিস্থিতির কারণে ২৭ কোটি লোক চাকরিহীন হয়ে পড়বে বলে আইএলওর পরিসংখ্যানে এসেছে। বাংলাদেশেও এই সংকট আসবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বেশ কয়েকটি খাতে এরই মধ্যে সহায়তা প্রদান করেছে। বাজেটের ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলোর প্রতিফলন আশা করেন তিনি।
এনবিআর সদস্য রঞ্জন কুমার ভৌমিক মার্জিনাল ট্যাক্স পেমেন্টের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সীমা আড়াই লাখ থেকে বৃদ্ধির বিষয়ে একটি ভিন্ন প্রস্তাবও বিবেচনার কথা বলেন। তিনি বলেন, আড়াই লাখ টাকার ওপরে আয় গেলে সেখান থেকে ১০ শতাংশ করের বিধান রয়েছে। এ কারণে আমরা এটিকে বাড়াতে বলি। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেটা করা হয়, এই হারটিকে ৫ শতাংশ করা হয়। কাজেই আমরা এই ব্যাপারটিও মার্জিনাল ট্যাক্সদাতাদের ক্ষেত্রে ভেবে দেখতে পারি।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন সিদ্দিকী বলেন, কর প্রদান বিষয়ে আমাদের যথাযথ জ্ঞান সৃষ্টি হওয়া খুবই জরুরি। অনেকেই এ বিষয়ে যথাযথ সচেতন থাকেন না। আমাদের মধ্যে যারা উপযোগী তাদের অবশ্যই কর প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি নিজস্ব দায়িত্ব পালন করা উচিত। আর এজন্য ট্যাক্স অথরিটিকে আরো শক্তিশালী ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে করে রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
বক্তব্যে আইসিএমএবি কাউন্সিল সদস্য এ কে এম কামরুজ্জামান বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আলিবাবা’র কর্ণধার জ্যাক মার বক্তব্য এবং ড. আতিউর রহমানের বক্তব্যের আলোকে বলেন, এ বছরের বাজেট আমাদের টিকে থাকার বাজেট। চলমান পরিস্থিতিতে আমরা যদি কোনোমতে টিকে যেতে পারি, সেটাই হবে আমাদের লাভ। আর তা যদি আমরা করতে পারি, তাহলে আগামী বছর আমাদের জন্য সাফল্যময় এক সোনালি বছর হবে।