Published in বণিকবার্তা on Wednesday 10 June 2020
আগামী ২০২১ অর্থবছরের বাজেট এমন একটি পটভূমিতে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেটি বাংলাদেশ কখনই দেখেনি। আসন্ন বাজেট উত্থাপনের সময় সারা বিশ্ব কভিড-১৯ অতিমারী রোধের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পর ২১৩টি দেশ এই অতিমারীর কবলে পড়েছে। এতে বাংলাদেশসহ সব দেশে দেশীয় ও বৈশ্বিক উভয় পর্যায়ে উৎপাদন এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে যাওয়ায় বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। দেশীয় এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সংযোগ থাকার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কর্মসংস্থান ও আয় কমে যাওয়ার ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে কমে গেছে। তাই বিশ্বজুড়ে প্রতিটি দেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সরবরাহ ও চাহিদা উভয়ই জোরদার করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে বার্ষিক বাজেটের মাধ্যমে অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটাতে আমাদের অনেক কিছু প্রত্যাশা করার কোনো কারণ নেই। তবে যেহেতু বাজেটের মাধ্যমে সরকারের নীতি নির্দেশনা এবং অগ্রাধিকারগুলো প্রতিফলিত হয়, তাই এটি অর্থনীতিকে উদ্দীপ্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে বাজেট প্রক্রিয়ায় ব্যয় ও সম্পদ সংস্থানের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের বাইরেও আমাদের ভাবতে হয়। চলমান কভিড-১৯ সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন বাজেটের সেই ভূমিকা নেয়ার প্রয়োজন আগের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং ২০২১ অর্থবছরের বাজেটে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত এবং অন্যদিকে আগামী দিনে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।
আমরা দেখেছি কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব ঘটার আগেই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো চাপে ছিল। রেমিট্যান্স ছাড়া অন্য সূচকগুলো যেমন রফতানি, আমদানি, বেসরকারি বিনিয়োগ, বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ, রাজস্ব আদায় এবং লেনদেনের ভারসাম্য ইত্যাদি নিম্নমুখী ছিল। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে রেমিট্যান্সসহ সব সূচকে পতন ঘটেছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে রফতানি আয় আরো কমেছে এবং এপ্রিলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ যথেষ্ট পরিমাণে কমেছে। কভিড-১৯-এর কারণে দেশব্যাপী লকডাউনের ফলে অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে যে সময়টাকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি, সেই সময়ে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অংকেও কমে গেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রবৃদ্ধি, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিষয়ক যে হিসাব করছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, ২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ হবে। অন্য সংস্থাগুলোও একই রকম অনুমান করেছে।
তার ওপরে আমাদের অর্থনীতিতে মাঝারি থেকে দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ, যেমন বর্ধিত হারে বেকারত্ব ও বৈষম্য বিদ্যমান। ফলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অনেকাংশেই ম্লান হয়ে যাচ্ছিল।
এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে হলে জনগণের হাতে অর্থ দিতে হবে। সেজন্য উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে সরকারি ব্যয় বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে মানুষের জন্য কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। বর্তমানের বাস্তবতায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যেসব প্রকল্প কম গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো স্থগিত রেখে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোকেই এখন প্রাধান্য দিতে হবে। প্রকল্পগুলো শুরুর সময়কাল, আকার ইত্যাদির ভিত্তিতে প্রাধিকার তালিকা করে সেটা সম্ভব। এখনকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় প্রকল্প হচ্ছে, যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এতে মানুষের হাতে অর্থ আসবে। ফলে অর্থনীতিতে গুণক প্রভাব পড়বে। অর্থনীতি চাঙ্গা ভাব ফিরে পাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বিগত দশকে যেমন ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, জনসাধারণের ব্যয়ের চাহিদাও তেমনি বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ-জাতীয় ব্যয়গুলোর বেশির ভাগই অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, যা কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করেছিল। ২০২১ অর্থবছরের জন্য সরকার প্রায় ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজেটের পরিকল্পনা করেছে। এটি ২০২০ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি এবং ২০২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। চলমান করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ের চাহিদা বেশি। সেই বিবেচনায় রাজস্ব আয়ের এই বৃদ্ধি যুক্তিযুক্ত মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে বড় বিষয় হলো বাস্তবায়ন, যেটি বাংলাদেশে খুব একটা সন্তোষজনক নয়। ২০২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ। লকডাউনের কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে এডিপি বাস্তবায়ন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে আগের বছরের তুলনায় এডিপি বাস্তবায়নের হার অনেক কম হতে পারে। ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চাহিদার জন্য এডিপির এই দুর্বল বাস্তবায়ন উদ্বেগজনক।
সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করার পাশাপাশি ব্যয়ের অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিচক্ষণ পরিকল্পনার প্রয়োজন। কেননা সম্পদের অপ্রতুলতা একটি বড় সীমাবদ্ধতা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ মন্দার কারণে কেবল ২০২০ অর্থবছরেই যে রাজস্ব সংস্থান কমবে তা নয়, আগামী বছরগুলোয়ও এই নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণ করোনার আগে যতটা সরকারি কোষাগারে অবদান রাখতে পারত, এখন আর সেটি তাদের পক্ষে সম্ভবপর হবে না। এতে করপোরেট ও ব্যক্তি পর্যায়ে আয়কর সংগ্রহ অনেক হ্রাস পাবে। বাণিজ্য কমে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক আদায়ও কমে যাবে। ২০২০ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো হতে পারে। এরই মধ্যে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করার জন্য সরকারের প্রণোদনা এবং ত্রাণ দেয়ার ফলেও সরকারি ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে ২০২০ অর্থবছরের রাজস্ব ঘাটতি সরকারের অনুমিত ৫ শতাংশের চেয়ে বেশি হবে। করোনার কারণে আগামী অর্থবছরে আরো সরকারি সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে ২০২১ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি আরো বাড়বে। পৃথিবীর সব দেশেই সেটি হবে।
বর্ধিত ব্যয় ও সীমিত আয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাটা সরকারের জন্য হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। করোনা উদ্ভূত সংকট দেখা দেয়ার পর সরকারের যে একটি কল্যাণকর ভূমিকা থাকে, সেটিই বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারি ব্যয় অব্যাহত রাখতে হবে এবং বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সঙ্গে দরিদ্র ও অসহায়, দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক, স্বল্প আয়ের উপার্জনকারী, অনানুষ্ঠানিক খাতের লোকদের সরকারের নগদ সহায়তা চালিয়ে যেতে হবে। তা না হলে সমাজের বৈষম্য আরো বাড়বে। এমনিতেই আমাদের দেশে ধনী-গরিবের মধ্যে আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য ও ভোগবৈষম্য ব্যাপক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বৈষম্য বেড়েই চলেছে। আমাদের আশঙ্কা করোনা এই বৈষম্য আরো বাড়িয়ে দেবে। এরই মধ্যে অতিদরিদ্র জনগণের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সুতরাং কভিডের ফলে বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য যে প্রতিজ্ঞা করেছে, তা পূরণ করা কষ্টসাধ্য হবে। আর এসডিজির যে মূলভাব অর্থাৎ কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না, সেটিও অর্জন করা যাবে না।
এছাড়া বাংলাদেশ ২০২৪ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার আশা করছে। এই আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তবায়নের জন্য সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো খুবই জরুরি। প্রবৃদ্ধির চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে আমাদের নজর দিতে হবে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার ওপর। তাদের হাতে অর্থ দেয়া। আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বিভিন্ন ধরনের পরিষেবা যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও পুষ্টির জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং সামাজিক খাতে পর্যাপ্ত সরকারি ব্যয় বাড়ানো অপরিহার্য। তবে শুধু বরাদ্দ নয়, বিতরণ ব্যবস্থায় দক্ষতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে না পারলে ব্যয় অর্থহীন। অধিক বরাদ্দ এবং উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও শিক্ষা খাতে অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে। তবে শুধু ভৌত অবকাঠামো এবং প্রশাসনিক ব্যয় করেই যদি বোঝানো হয় যে এ খাতগুলোয় ব্যয় বেড়েছে, সেটিও কোনো কার্যকরী ফল দেবে না। বাজেটের গুণগত মান নিশ্চিত করা যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিদ্যমান এবং করোনার পরিপ্রেক্ষিত নতুন চ্যালেঞ্জগুলো রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়। সামনের দিনগুলোয় কী আছে, সেটাও কেউ জানে না। তাই এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে বাস্তবতার নিরিখে একটি বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতো গতানুগতিক পথ অনুসরণ না করে ২০২১ এবং তার পরবর্তী অর্থবছরগুলোর জন্য বাজেট প্রণয়নের বেলায় চারটি বিষয়ে বিশেষ নজর দেয়া উচিত। প্রথমত, রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য করজালের আওতা বাড়াতে হবে; কর ফাঁকি রোধ করতে হবে; দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে; পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য আইনগত ব্যবস্থা শুরু করতে হবে; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিদ্যমান সক্ষমতা বাড়াতে হবে; শক্তিশালী বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে, ব্যয় করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে; এসব কাজে নিয়োজিত মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, সামাজিক খাতগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে; সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা চালু করতে হবে। চতুর্থত, অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন বজায় রাখতে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)