Published in প্রথম আলো on Monday 15 June 2020
১৯৯৭ সালের জুন মাসের এক সকালে ফোন করলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার শাহ এ এম এস কিবরিয়া। কিবরিয়া সাহেব তাঁর সামষ্টিক অর্থনৈতিক উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় আমাদের সঙ্গে প্রায়ই তথ্য-উপাত্তের প্রাপ্যতা নিয়ে আলোচনা করতেন। সেবার তিনি জানতে চাইলেন তাঁর বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখিত একটি সংখ্যার সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রণীত সংক্ষিপ্ত বাজেট বিবৃতির মধ্যে যে অসামঞ্জস্যের কথা আমি গতকাল বলেছি, সেটি কী ছিল। আমি বিনয়ের সঙ্গে ব্যাখ্যা করলাম এবং উনি ধৈর্য ধরে শুনলেন। আরেক অর্থমন্ত্রী, দুঃখজনকভাবে নিহত এম সাইফুর রহমান তো ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে সিপিডির গবেষকদের তাঁর দপ্তরে মুখোমুখি করলেন সরকারি পরিসংখ্যানের দায়িত্বে থাকা শীর্ষ কর্মকর্তাদের। যেটা বলতে চাইছি তা হলো বাংলাদেশে মুখ্য অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সরকারি তথ্য-উপাত্তের সঠিকতার গুরুত্ব অনুধাবনের ক্ষেত্রে একটি অনুকরণীয় ঐতিহ্য আছে।
দুঃখের বিষয়, সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে সাম্প্রতিক কালে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের কতগুলো কাঠামোগত ও ব্যবহারিক দুর্বলতা আছে। যেমন অভিন্ন সূচকের ওপর তথ্য একেক প্রতিষ্ঠান একেকভাবে দেয়। যেমন অর্থ মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব আদায়ের হিসাবের সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের হিসাবের পার্থক্য রয়েছে। রপ্তানি আয়ের পরিমাণের ক্ষেত্রে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের হিসাব মেলে না।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান তৈরিতে ভিত্তিবছর ও ব্যবহৃত গুণাঙ্কগুলো প্রায়ই বহু পুরোনো ও অপ্রাসঙ্গিক। এর একটা কারণ বিকাশমান খাতগুলো অনেক সময়ই হিসাবের বাইরে থেকে যায়। এটি পরিষ্কার দেখা যায় শিল্পের ভৌত উৎপাদন সূচক নিরূপণের ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা প্রয়োজনীয় উপাত্ত সংগ্রহ করি না। যেমন বিভাজিতভাবে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও ভোক্তা চাহিদা। সরকারি ব্যয়ের ফলাফল ও মূল্যায়ন করা হয় না।
আমরা জানি, প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন উপাখ্যানের মূল প্রতিপাদ্য। দুঃখের বিষয়, এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অনুমিতি নিয়ে সাম্প্রতিক কালে গুরুতর সংশয় উত্থাপিত হয়েছে। এর মূল কারণ হলো প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসম্পাদনের সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ অনুমিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে হলে যে পরিমাণ ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ, পুঁজিপণ্য আমদানি, জ্বালানি ব্যবহার, রাজস্ব আদায় ইত্যাদি হওয়ার কথা, তা পরিলক্ষিত হয় না। সমাপ্য অর্থবছরের জন্য অনুমিত ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার এই সংশয়ের মাত্রাকে নিয়ে গেছে নতুন পর্যায়ে। বিশেষ করে যখন সব আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি জাতীয় উৎস বলছে ২-৩ শতাংশের মধ্যে এটি থাকার কথা। মনে রাখতে হবে, গত তিন মাসের ‘সাধারণ ছুটি’র কারণেই শুধু অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয়, তার আগের ৯ মাসেও একমাত্র অনাবাসী আয় ছাড়া আর সব সূচকই ছিল দুর্বল।
আগেই বলেছি, অর্থনীতির একটি সূচক একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। একটিকে আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ঠিক করতে গেলে অন্যগুলো বেঠিক হয়ে যায়। তাই হয়েছে সমাপ্য অর্থবছরের জন্য অনুমিত ব্যক্তি বিনিয়োগের হারের ক্ষেত্রে। উল্লেখিত ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যা হঠাৎ করে অর্ধেক হয়ে গেছে এবং পরের বছর (২০২০-২১) আবার অবিশ্বাস্যভাবে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আর যদি ব্যক্তি খাতের হার প্রকৃতই এত পতন হয়ে থাকে, তবে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন নিয়ে আমাদের শঙ্কা ও পরিকল্পনা ভিন্নতর হওয়ার কথা।
এ অসংগতিগুলো আরও ভালো ধরা পড়ে যদি আমরা বাজেটে প্রদত্ত তথ্যগুলোর সঙ্গে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে (২০১৫-২০) অর্জিত পরিসংখ্যান এবং নতুন মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক কাঠামোয় (২০২১-২৩) উল্লেখিত সংশ্লিষ্ট সংখ্যাগুলোর তুলনা করি। গুরুত্বপূর্ণ হলো আগামী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে করোনা আক্রান্ত বর্তমান বাংলাদেশ অর্থনীতি অথবা মন্দাক্রান্ত বিশ্ব অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। আগামী বছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে আমাদের একটি রাজনৈতিক প্রত্যাশা হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে।
তথ্য ও উপাত্তের বাস্তবতাবিবর্জিত ব্যবহারের আরেকটি উদাহরণ হলো যেভাবে পরবর্তী বছরের জন্য বাজেটীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এই হিসাবগুলো করা হয় চলমান অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের সংখ্যাগুলোর ওপর ভিত্তি করে। আর্থিক বছর শেষে এই সংখ্যাগুলো অনেকটাই অনার্জিত থেকে যায়। এর ফলে পরবর্তী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রাগুলো দলিলে কম দেখালেও কার্যত তা অস্বাভাবিক বেশি। এর কারণেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আগামী এক বছরে কার্যত দেড় গুণ কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে দুশ্চিন্তায় জর্জরিত।
চলমান সময়ে করোনা অতিমারির কারণে সরকারি পরিসংখ্যান পরিস্থিতি আরও সমস্যাসংকুল হয়ে উঠেছে। তথাকথিত ‘সাধারণ ছুটি’র সময় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ‘প্রয়োজনীয়’ সরকারি দায়িত্বে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। উপরন্তু একটি বিকাশমান দুর্যোগের মধ্যে পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আর্থসামাজিক গোষ্ঠী, কর্মকাণ্ড ও প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতা ও তৎপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ সীমাবদ্ধতার কথা নিজেই উল্লেখ করেছেন।
তবে লক্ষণীয় যে প্রবৃদ্ধির হারসহ অন্যান্য যেসব সূচক নিয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি, তা প্রথাগতভাবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছ থেকে আসার কথা। কিন্তু এবার তা এসেছে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। আমরা অপেক্ষা করব পরবর্তী সময়ে এই সূচকগুলোর কী অনুমিতি আসে বিবিএস থেকে তা দেখার জন্য। এটি একইভাবে সত্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছরে (২০১৯-২০) পূর্ণ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে, যা পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ থেকে আসবে।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার তথা সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি নিরাময়ে যথেষ্ট পরীক্ষিত উপায় আছে। যেমন বিভিন্ন দেশে ত্রৈমাসিক জিডিপি বৃদ্ধির হারের হিসাব করা হয়। বাংলাদেশে একবার ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ করে তা অজ্ঞাত কারণে দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয়। হিসাবের সঠিকতা যাচাই করার জন্য অনেক দেশেই স্বাধীন বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী নিয়োগ দেয়। অনেক সরকারই প্রবৃদ্ধির অনুমিতির ওপর আস্থা বৃদ্ধির জন্য হিসাবের অনুমান ও পেছনের হিসাবগুলো প্রকাশ করে থাকে। উপরন্তু আজকাল উপগ্রহের মাধ্যমে সংগৃহীত উপাত্ত, ব্যক্তি খাত থেকে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মতো তথ্য, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া বিভিন্ন নমুনা জরিপ, সামাজিক সংস্থাগুলো পরিচালিত জনমত জরিপ ইত্যাদি সরকারি হিসাবের সঠিকতা যাচাইয়ের মাপকাঠি হিসেবে বেশ প্রচলিত হয়েছে। অবশ্য কোনো কোনো দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিকল্প হিসাবে অতিরঞ্জনের অভিযোগ এসেছে, যা রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যানের বর্তমান অপ্রাপ্তিবোধ অনেকটাই নিরসন করা সম্ভব প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সমন্বয় বৃদ্ধির মাধ্যমে। কিন্তু তবে আরও প্রয়োজন পড়বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানকে রাজনৈতিক অনুমোদন দেওয়ার প্রথা থেকে বের হয়ে আসা।
সরকারি পরিসংখ্যান হচ্ছে একটি ‘গণ পণ্য’। অর্থাৎ জাতীয় নিরাপত্তা বা আমাদের মাতৃভাষার মতো। এটির সমভাবে সর্বজনীন প্রয়োজন মেটানোর কথা। মিডিয়া যদি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হয়, তবে পরিসংখ্যানকে অনেক দেশে পঞ্চম স্তম্ভ হিসেবে ধরা হয়। সরকারি পরিসংখ্যানের গুণমান, লভ্যতা ও ব্যবহারযোগ্যতার ওপর নির্ভর করে সরকারের নীতিমালা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও কার্যকারিতা। এ ক্ষেত্রে লেখার শুরুতে উল্লিখিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে করোনাক্রান্ত বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্তের ব্যাপারে আরও মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ