Published in প্রথম আলো on 19 October 2020
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রবৃদ্ধির তুলনামূলক হিসাব উভয় দেশেই ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আইএমএফ হিসাব করে বলেছে যে ২০২০ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৭ দশমিক ৯৭ মার্কিন ডলার। আর ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ মার্কিন ডলার। এর পাশাপাশি ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং ভারতের জিডিপি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ কমবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত তার ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ নামক প্রতিবেদনটিতে সারা বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে পূর্বাভাস দিয়েছে, এই নিরূপণ তার অংশ।
তবে সামনের বছরগুলোয় দুই দেশের অর্থনীতির পরিবর্তন একই তালে চলবে না। আইএমএফের আউটলুক থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। আর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৪.৪ শতাংশ। ফলে, ২০২১ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ৩০ মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশের হবে ১ হাজার ৯৯০ মার্কিন ডলার। ২০২৫ সাল পর্যন্ত আইএমএফের প্রক্ষেপণ বলছে, মাথাপিছু জিডিপিতে ২০২৪ সালে ভারত বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাবে এবং ২০২৫ সালে আবার মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকবে।
আইএমএফের এই প্রক্ষেপণের প্রতিক্রিয়া উভয় দেশেই বিভিন্নভাবে করা হয়েছে। এ অর্জনের জন্য বাংলাদেশের সরকার স্বাভাবিকভাবেই আনন্দিত এবং গর্বিত। অনেক বিশ্লেষক এ জন্য সরকারের নীতিমালা ও প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ দিয়েছেন। আবার অনেকে বাংলাদেশ যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, সেগুলো তুলে ধরে তা দূর করার পরামর্শ দিয়েছেন।
ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করেছে। তারা ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা কী ভুল করেছেন আর বাংলাদেশ কীভাবে ভালো করেছে, সেগুলো তুলে ধরেছে। ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দল এটিকে বর্তমান মোদি সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখেছে। অনেকে বলছেন, কোভিড-১৯ অতিমারি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই ভারতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের আরেকটি অংশ বাংলাদেশের অর্জনকে খুব একটা ভালোভাবে দেখেনি; বরং তারা এটিকে খাটো করে বেশ কিছু নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরেছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পে কমপ্লায়েন্সের অভাব, চরম রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি এবং ইসলামি উগ্রবাদকে বাংলাদেশের সমস্যা বলে উল্লেখ করেছে।
তবে তাদের এই বক্তব্য পুরোপুরি সঠিক নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের খাতটি বিভিন্ন ধরনের কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে উন্নতিসাধনের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে সফল হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কয়েকটি ঘটনার পর কঠোর হাতে দেশে ইসলামিক উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই বৈশ্বিক প্রচেষ্টা ছাড়া ধর্মীয় উগ্রবাদকে নির্মূল করা সম্ভব নয়।
পৃথিবীতে বহু দেশ রয়েছে, যেগুলোর আয় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে তারাও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা এবং দুর্নীতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ সব স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে অতি পরিচিত সমস্যা।
মাথাপিছু জিডিপির হিসাব নিয়ে দুই দেশের কারওরই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এর পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে, তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমত, জিডিপি যেভাবে হিসাব করা হয়, সেটি একটি ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি। জিডিপি শুধু যেসব পণ্য ও সেবা বাজারে অর্থের বিনিময়ে কেনাবেচা করা যায়, সেগুলোকেই হিসাবের মধ্যে নেয়। বেতনবিহীন ঘরের কাজ, পারিবারিক সেবা, সমাজসেবা ইত্যাদি, অর্থাৎ যেগুলোর জন্য কোনো আর্থিক মূল্য পাওয়া যায় না, সেগুলোকে গণনার মধ্যে নেয় না। আবার অনেক ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড করলেও জিডিপি বাড়ে। যেমন গাছ কেটে বাজারে বিক্রি করলে সেই অর্থও জিডিপিতে যোগ হয়। অথচ গাছ কাটলে পরিবেশ বিনষ্ট হয়। মানুষের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়। এ রকম অসংগতিমূলক অনেক কারণে জিডিপি একটি সংকীর্ণ সংখ্যা। এটি অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে না। তাই নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন, যোসেফ স্টিগলিট্জসহ অনেক অর্থনীতিবিদ জিডিপি পরিমাপের পদ্ধতিটি মান্ধাতার আমলের এবং ত্রুটিপূর্ণ বলে এসেছেন। সুতরাং, এটি সাফল্য অর্জনের নির্ধারক হতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, চলতি বাজারমূল্যে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের জিডিপির তুলনা করা সঠিক নয়। ডলারের মূল্য সব দেশে সমান হয় না। বাংলাদেশে এক ডলার দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য এবং সেবা কেনা যাবে, অন্য দেশে সমপরিমাণ কেনা যাবে না। জীবনযাত্রার ব্যয় একেক দেশে একেক রকম। এ কারণেই চলতি মূল্যভিত্তিক জিডিপির পরিবর্তে ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির (পিপিপি) ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের জিডিপি তুলনা করা হয়। সুতরাং, পিপিপির ভিত্তিতে হিসাবকৃত মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত এখনো বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। ভারতের মাথাপিছু পিপিপি-জিডিপি ৬ হাজার ২৮৪ মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশের ৫ হাজার ১৩৯ মার্কিন ডলার।
তৃতীয়ত, আইএমএফের জিডিপির এই হিসাব অনেক অনুমাননির্ভর এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ সংখ্যাও পরিবর্তিত হতে থাকে। কখনো কখনো পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হতে থাকে এবং তা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। কিন্তু তা জিডিপির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। জিডিপির হিসাব ওলট–পালট করে দেয়। তার প্রমাণ চলমান কোভিড-১৯ অতিমারি। কে জানত যে বিশ্ব অর্থনীতি ২০২০ সালে টিকে থাকার জন্য লড়াই করবে? আর গত বছর করা সব প্রক্ষেপণ আমাদের পরিবর্তন করতে হবে? অনিশ্চিত এই বিশ্বে আজকের জিডিপির সংখ্যা যেকোনো সময় পরিবর্তিত হতে পারে। তাই পরিবর্তনশীল এই সংখ্যা নিয়ে এত তুলনা করার কিছু নেই।
চতুর্থত, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব রাজনৈতিকভাবে কাম্য নয়। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। এর অর্থনীতির আকার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড়। তবু অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী প্রতিবেশী পেলে ভারতের জন্য তা হবে মঙ্গলজনক। বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তাদের কাছে ভারতীয় পণ্য ও সেবার চাহিদা বাড়বে। ভারতে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশি রোগীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভারতে শিক্ষা গ্রহণ করছেন। এখন বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যবাধা অপসারণের লক্ষ্যে এবং পানি বণ্টন চুক্তির মীমাংসার জন্য একসঙ্গে কাজ করতে পারে।
মাথাপিছু জিডিপির প্রক্ষেপণ নিয়ে বাংলাদেশের আত্মতুষ্টিতে ভোগা ঠিক হবে না। কেননা, উচ্চ প্রবৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতিতে বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা সুস্পষ্ট। স্বল্প রাজস্ব আয় এবং বিনিয়োগ এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আইএমএফের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে মাত্র ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন
বাংলাদেশের জন্য ভারতের চেয়ে উচ্চতর মাথাপিছু জিডিপি একটি উল্লেখ্যযোগ্য অর্জন বটে। ভারত একটি উন্নয়নশীল দেশ আর বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতারে রয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশ স্থিতিশীল এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। সেই সঙ্গে স্বাধীনতার পর থেকে সক্রিয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস করতে সফল হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এর সঙ্গে নীতিগত পদক্ষেপ তো রয়েছেই।
এখন এই অতিমারির সময়েও বাংলাদেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। কৃষির উচ্চ ফলন, ভালো রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশের অর্জন সবার জানা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) বেশ কয়েকটি সূচকে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। এমডিজির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো (এসডিজি) বাস্তবায়নেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জাতিসংঘ–নির্ধারিত মাথাপিছু মোট জাতীয় আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক—এই তিনটি মানদণ্ডই বাংলাদেশ পূরণ করতে পেরেছে। এর ফলে বাংলাদেশ ২০২৪ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।
তবে মাথাপিছু জিডিপির প্রক্ষেপণ নিয়ে বাংলাদেশের আত্মতুষ্টিতে ভোগা ঠিক হবে না। কেননা, উচ্চ প্রবৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতিতে বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা সুস্পষ্ট। স্বল্প রাজস্ব আয় এবং বিনিয়োগ এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আইএমএফের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে মাত্র ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকারের ব্যয়ক্ষমতা সীমিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সরকারি ব্যয় বাংলাদেশ সবচেয়ে কম। এটি জিডিপির মাত্র ১৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ২৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা নেপাল ও ভুটানের তুলনায় অনেক কম এবং ভারতের কাছাকাছি (২৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ)। এর ফলে অর্থনীতি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না। তা ছাড়া উচ্চ প্রবৃদ্ধি–বৈষম্য দেশের ভেতরে হ্রাস করতে পারেনি। এর জন্য প্রয়োজন সুশাসন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, যাতে সবাই প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে পারে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং কর্মদক্ষতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অত্যাবশ্যক। এটি এখনো একটি অসম্পূর্ণ কাজ।
সুতরাং, বাংলাদেশের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ হলো একদিকে প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখতে দুর্বল জায়গাগুলোকে শক্তিশালী করা, আর অন্যদিকে প্রবৃদ্ধিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া।
ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।