Published in বণিকবার্তা on 10 November 2020
শামীমা বেগম। সাতক্ষীরার নওয়াবেকি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি একজন গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি হাঁস-মুরগি পালন করতেন, রেস্তোরাঁ চালাতেন, সিরামিকের স্ল্যাব বানাতেন, একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের ক্ষুদ্র ঋণ বছরে বাংলাদেশে অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক তাকে শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পুরস্কার দেয়। তারই অংশ হিসেবে শামীমা বেগম জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউইয়র্কে গিয়ে বক্তৃতা দেন। তিনি বাংলাদেশের জন্য অনেক সম্মান কুড়িয়ে আনেন, তার এলাকার বাসিন্দা তথা গ্রামীণ নারীদের জন্য একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তাকে তখন ব্যক্তিগতভাবে জানার সুযোগ হয়েছিল। তিনি তার স্বামী নিয়ে আমার বাসায় বেড়াতেও এসেছিলেন। তার উদ্যোগী কর্মোদ্যম আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
তার কিছুদিন পর জানতে পারলাম শামীমা হাসপাতালে। তার স্বামী তার মাথা ফাটিয়ে দেন। শামীমারই প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিকের সেবিকার সাথে তার স্বামীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। শামীমা এর প্রতিবাদ করতে গেলে স্বামী তাকে প্রচণ্ড মারধোর করে। জাতিসংঘে সম্মান পাওয়া এই সেরা নারী উদ্যোক্তাকে স্থানীয় পুলিশ এসে রক্ষা করে।
সাম্প্রতিক কালে নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীর শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে নারী সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। শুধু ঘরে নয়, বাইরে নারীরা ক্রমাগতভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কেন আমরা এ অবস্থার মধ্যে বসবাস করছি, সমস্যাটা কোথায়, কোন পেশার বা কোন জায়গার নারীরা বেশি নির্যাতিত, কীভাবে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। সাধারণভাবে একটা ধারণা রয়েছে যে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকেলে তাকে আর নির্যাতনের শিকার হতে হবে না। তখন পুরুষ তাকে ভয় পাবে, নারীও তাকে ভয় পাবে। তাকে সবাই সম্মান করবে। কিন্তু শামীমা বেগম বা অনেক বর্তমানের কর্মজীবী নারীদের জীবন সেটি বলে না। শামীমা বেগমের মতো হাজারো গ্রামীণ নারী স্বাবলম্বী হয়েছে, ভালো উপার্জন করছে। নারীদের কাজের কিছু তথ্য এখানে দেয়া যেতে পারে। এরপর নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টিতে আবার ফিরে আসব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার ছিল ২৩.৯ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৬.৩ শতাংশ। এর মধ্যে কৃষিতেই সর্বোচ্চসংখ্যক নারী নিয়োজিত। ২০১৭ সালের বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী শতকরা ৫৯.৭ ভাগ নারী কৃষিতে কাজ করছে। শিল্প খাতে ১৬.৮ শতাংশ, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ১৫.৪ শতাংশ ও সেবা খাতে ২৩.৫ শতাংশ। ২০১০ সালের তুলনায় খাতওয়ারি অংশগ্রহণ পরিবর্তিত হয়েছে। ২০১০ সালে নারীদের খাতওয়ারি অংশগ্রহণ ছিল কৃষিতে ৬৪.৮, শিল্প খাতে ১৩.৩ শতাংশ, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ১১.৭ শতাংশ ও সেবা খাতে ২১.৮। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে, নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের ধারা থেকেও সেটি লক্ষণীয়।
আবহমান কাল ধরে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে নারীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।এর মাধ্যমে তারা গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। গৃহস্থালি কাজ ছাড়াও শাকসবজি উৎপাদন, হাঁস-মুরগি পালন, পশুপালন, কৃষির সাথে সম্পর্কিত অনেক ধরনের কাজ ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামের নারীরা করে আসছে। এর বিনিময়ে তারা কোনো অর্থ না পেলেও পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য আনার জন্য নারীরা যুগ যুগ ধরে নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত।
তবে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে কালের পরিক্রমায় যে বিবর্তন এসেছে তার ফলে কাজের ধরন পরিবর্তিত হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজ রূপান্তরের সাথে সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে পরিবর্তনগুলো লক্ষণীয় হয়েছে সেখানে নারীর কাজের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। তাদের কাজের মধ্যেও বৈচিত্র্য এসেছে। তারা ঘরের বাইরে এসে গ্রামে, উপশহরে এবং শহরে কাজে নিয়োজিত হয়ে উপার্জন করছে। এমনকি বাড়ির ভেতরে থেকেও অনেক অর্থকরী কাজ করে পরিবারে অবদান রাখছে। কৃষির বাইরে এসে তারা উদ্যোক্তা হয়েছে। কুটির শিল্পে নিয়োজিত হয়েছে। ছোট ব্যবসায় জড়িত হয়েছে। নানা পেশায় তারা যুক্ত হয়েছে।
ফলে কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় কিছুটা কমে এলেও কৃষি খাতেই নারীর অংশগ্রহণ এখনো বেশি। বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণন পর্যন্ত বিভিন্ন কাজেই নারী অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এতে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নারীরা কৃষির সাথে সম্পর্কিত শুধু ছোটখাটো কিছু কাজ করছে না। তারা ধান উৎপাদন ও মাছ চাষসহ অন্যান্য কাজ, এমনকি বাজারজাতের কাজও করছে। তবে কৃষিতে নারীরা অধিক হারে অংশগ্রহণ করলেও কৃষক হিসেবে পরিবারে তাদের মূল্যায়ন করা হয় না এবং সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। কৃষি থেকে পারিবারিক আয়ে নারীদের ভাগ থাকে না। কৃষিতে নারীর কাজ হচ্ছে অবৈতনিক, কারণ এটিকে পারিবারিক শ্রম গণ্য করা হয়। অন্যদিকে কৃষিঋণসহ সব সরকারি সুযোগ-সুবিধা নারী কৃষকরা পায় না। তাছাড়া ভূমিতে নারীর সমঅধিকার নেই। বাজারে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রেও নারীরা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। তাদের জন্য বাজারে আলাদাভাবে কোনো জায়গা নির্দিষ্ট করে রাখলে তাদের পণ্য বাজারজাতের সুবিধা বাড়বে।
অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান শুধু কৃষির মাধ্যমে নয়। শিল্প ও সেবা খাতে গ্রাম থেকে আসা নারীরা কাজ করছে। বাংলাদেশের রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ গ্রামীণ নারীদের শ্রম ছাড়া সম্ভব ছিল না। গ্রামের দরিদ্র, ভূমিহীন অথবা স্বল্প ভূমির মালিক কিংবা বর্গাচাষী—এ ধরনের পরিবার থেকে স্বল্প শিক্ষিত নারীরা আশির দশকের মাঝামাঝি যখন তৈরি পোশাক শিল্প খাতের বিকাশ ঘটতে শুরু করল তখন থেকেই তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে কাজ শুরু করল। অনেক নতুন নতুন কাজেও নারীরা যুক্ত হলো। বিবিএসের ভাগ অনুযায়ী দেখলে প্রতিভাত হয় যে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানিসম্পদ, খনিজ ও খনন, নির্মাণ, পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ, আর্থিক প্রাতিষ্ঠানিক সেবা, রিয়েল এস্টেট, ভাড়া ও অন্যান্য, লোকপ্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা, কমিউনিটি ও ব্যক্তিগত সেবা ইত্যাদি কাজে নারীর অংশগ্রহণ বিস্তৃত হয়েছে। অর্থাৎ অনেক প্রথাগত পেশার বাইরেও তারা কাজ করছে। প্রবাসে কাজ করে নারী কর্মীরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তবে নারীর কাজের ধরন বেশির ভাগই অনানুষ্ঠানিক। বস্তুত অনানুষ্ঠানিক খাতেই মোট নারীশ্রমের শতকরা ৯১ ভাগের বেশি নিয়োজিত। ফলে তাদের উপার্জন অনেক কম এবং তারা মজুরিবৈষম্যেরও শিকার হচ্ছে।
তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ নারীদের ব্যাপক সংখ্যায় গ্রাম থেকে বাইরে এসে শ্রমবাজারে অংশ নেয়ার ফলে অনেক ধরনের সামাজিক পরবর্তন এসেছে। নারীদের কিছুটা ক্ষমতায়ন হয়েছে। তাদের হাতে অর্থ আসার ফলে পরিবারে তাদের মূল্য বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা পারিবারিক বিষয়ে মতামতও দিতে পারছে। নারীদের আয়ে পরিবারে খাদ্যপুষ্টি বেড়েছে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার বেড়েছে, বাল্যবিবাহ কমেছে, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। বিভিন্ন গবেষণায় তাই উঠে এসেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্জনের পেছনে নারীর অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের বেলায় নারীর ভূমিকা অনেক স্পষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সরকারি কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ক্ষুদ্র ঋণ আয় অর্জনমূলক কাজের মাধ্যমে অনেক নারীদের অর্থনৈতিক অবস্থান উন্নত হয়েছে। সরকারি নীতিমালা ও উদ্যোগও এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
গ্রামীণ নারীদের অগ্রগতিকে আরো এগিয়ে নিতে হলে তাদের জন্য একদিকে দরকার উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। শহুরে নারীর অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে শিক্ষা একটি ভূমিকা রেখেছে। তার প্রতিফলন নারীর কর্মসংস্থানের বৈশিষ্ট্য থেকে অনেকটা বোঝা যায়। প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা কাজে তাদের অংশগ্রহণ খুব কম। কারিগরি ও পেশাগত কাজেও তেমন বেশি নয়। গ্রাম থেকে শহরে আসা কর্মজীবী নারীরা তাই স্বল্প আয়ের কাজগুলোতেই বেশি নিয়োজিত।
তবে এ পর্যন্ত গ্রামীণ নারীদের যে অগ্রগতি হয়েছে তাও কম নয়। কিন্তু সেই উন্নতি অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় যখন এই নারীরা পুরুষ দ্বারা লাঞ্ছিত হয়। শুধু ঘরের ভেতরে নয়, ঘরের বাইরেও পুরুষ নারীকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে চলেছে। কাজে যাওয়ার পথে, কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে, স্কুলে যাওয়ার পথে, আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে, কাজের জায়গায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিসে—সর্বত্র পুরুষ ছোবল দেয়ার অপেক্ষায় বসে আছে। কোনো নারী বাইরে বের হলে সে নিরাপদে সসম্মানে ঘরে ফিরতে পারবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। আবার ঘরেও যে সে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে তাও নয়। সেখানেও পুরুষ হানা দেয়। সর্বত্র তার জন্য অপেক্ষা করে ভয়ংকর পরিস্থিতি।
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে অনেক অগ্রগতি হওয়ার পরও কেন নারীদের প্রতি এত সহিংসতা, কেন তাদের প্রতি এত অসম্মান? তাহলে কি অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সাথে এর তেমন সম্পর্ক নেই? বর্তমান পরিস্থিতি তাই বলে। আসলে কোনো একটি দিক দিয়ে সহিংসতার কারণ ব্যাখ্যা করা যাবে না। নারীর প্রতি সহিংসতাকে বিশেষজ্ঞরা অনেক তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। সবাই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে কোনো একটি বিশেষ কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা সংঘটিত হয় না। নারী ও পুরুষের মধ্যে একটি অসম ক্ষমতার সম্পর্কের কারণে এটি হয়ে থাকে। নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংসতার পেছনে একটি কাঠামোগত দিক রয়েছে। সব জায়গায়ই পুরুষ মনে করে নারীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতি করার অধিকার তার রয়েছে। তাই নারী ঘরে ও বাইরে দুই জায়গাই নিরাপত্তাহীন।
নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল্যবোধ শেখানোটা একটা গৌণ বিষয়। মানসম্মত ও সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা থেকে আমারা ক্রমশ সরে যাচ্ছি। তাছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য যে মূল্যবোধ তৈরি করা দরকার তা না করেই প্রযুক্তির ব্যবহার মানসিক অবক্ষয় তৈরি করছে। যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমরা বাস করছি তা নিজেকে জাহির করার, নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করার, অন্যকে হেয় করার। অর্থবিত্ত হয়ে গেছে সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠি। অর্থ হলেই নিয়ম ভঙ্গ করে পার পাওয়া যায়। সেই সাথে দুর্বলের ওপর অত্যাচার করলে এ সমাজে কেউ কিছু বলবে না, কোনো বিচার হবে না—এ মানসিকতা অন্যায়কারীদের মনে গেঁথে বসেছে। এ মানসিকতার কারণেই আমরা দেখি ছোট ছেলেকে গাছের সাথে বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, আর সবাই তা অবলোকন করছে। আত্মনির্ভর নারীকে ঘরে বা ঘরের বাইরে অত্যাচার করা হয় সেই একই মানসিকতা থেকে। আরো একটি বিকৃত মানসিকতা কাজ করে। কোনো নারীকে অবদমিত করার কিংবা তার পরিবারকে শাস্তি দেয়ার জন্য ও পুরুষ এই পাশবিক পন্থা বেছে নেয়। তারা জানে যে আমাদের সমাজে কোনো মেয়ের সম্ভ্রম হানি হলে সে এবং তার পরিবার শেষ হয়ে যাবে।
তবে অন্য সব বিষয় সমাধান হলেও রাজনৈতিক কারণটি দূর করা না গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। সমাজে যদি আইনের শাসন না থাকে, অন্যায়কারীর যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয়, তাহলে সব ধরনের অন্যায়ই বাড়তে থাকবে। এমনকি সে যদি নিরাপত্তার জন্য বাবা, ভাই বা কোনো পুরুষ আত্মীয়কে সাথে নিয়েও চলাচল করে তবুও সে অপরাধীর থাবা থেকে রক্ষা পায় না। দেখা যাচ্ছে ধর্ষণকারী কিংবা খুনি গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে নিচ্ছে। প্রভাবশালীদের ছায়ায় থেকে তারা অপরাধ করে যাচ্ছে। আবার যার কোনো ক্ষমতাশালীর সাথে যোগাযোগ নেই সেও নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখে তাকে আক্রমণ করছে। তার মনের মধ্যেও এই বিশ্বাস গেঁথে গেছে যে তার কোনো বিচার হবে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
নারীরা এ ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে তারা কাজ করতে কুণ্ঠা বোধ করবে। গত পাঁচ দশকে আমরা নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে যতটুকু এগিয়েছি তা হারিয়ে ফেলব। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অধিক হারে নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীদের আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্রে তারা অংশগ্রহণ করতে পারলে তাদের পরিবারের ও সমাজের উন্নয়ন সম্ভব হবে। এ কাজগুলোর সুযোগ দিতে হলে তাদের জন্য যে বিষয়গুলো বিশেষ করে দরকার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিক্ষা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান। আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পার্থক্য না থাকলেও উচ্চশিক্ষার বেলায় মেয়ে শিক্ষার্থী ছেলে শিক্ষার্থীর চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। তার প্রতিফলন নারীর কর্মসংস্থানের বৈশিষ্ট্য থেকে অনেকটা বোঝা যায়। প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা কাজে তাদের অংশগ্রহণ খুব কম। কারিগরি ও পেশাগত কাজেও তেমন বেশি নয়। গ্রাম থেকে শহরে আসা কর্মজীবী নারীরা তাই স্বল্প আয়ের কাজগুলোতেই বেশি নিয়োজিত। উদ্যোক্তা নারীর জন্য প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা, সঠিক তথ্য, পণ্য বাজারজাতের সুবিধা ইত্যাদি।
কিন্তু নারীরা যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং বাইরে কাজ করতে না পারে তাহলে এগুলোর কোনোটিই কাজে লাগবে না। আর তখন সমাজের অগ্রগতিও সম্ভব হবে না। আমরা কোন পথে যাব সেটি আমাদেরই নির্ধারণ করতে হবে।
ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)