Published in প্রথম আলো on 19 November 2020
বিশ্ব যখন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন তার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা কেমন হবে এবং তার প্রভাব কেমন হবে, তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশেও অনেক কিছু ভাবা হচ্ছে এবং জল্পনাকল্পনা চলছে। তবে শুধু বাংলাদেশ নিয়ে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেবেন বা নতুন মার্কিন প্রশাসনের ভাবনায় বাংলাদেশ আলাদাভাবে থাকবে, এমন আশা করা কঠিন। তাদের সামনে ইতিমধ্যেই একটি বিশাল কর্মসূচি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে বেশ কিছু বৈশ্বিক নীতিমালা, যা বাইডেন প্রশাসন নিতে পারে, সেগুলোর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়বে।
প্রথমটি হলো জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সের (জিএসপি) সিদ্ধান্ত। জিএসপির অধীনে রপ্তানিকারক দেশগুলোকে আমদানিকারক দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা দেওয়া হয়। জিএসপি হলো বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম মার্কিন বাণিজ্য অগ্রাধিকার কর্মসূচি, যা রপ্তানিকারক দেশগুলোর বিভিন্ন পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক–বাধা সরিয়ে দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সহযোগিতা করা হয়। এর লক্ষ্য বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর অনেককে বাণিজ্য–সুবিধা প্রদান করার মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এবং দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দেওয়া।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ যোগ্য। বিশ্বব্যাংকের ভাগ অনুসারে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং জাতিসংঘের শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে একটি স্বল্পোন্নত দেশ। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে ২০২৪ সালে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। তারপর আরও তিন বছর স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারবে। তবে ২০২৭-এর পর স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রদত্ত সুবিধাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মসৃণভাবে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন বাণিজ্য–সুবিধা বাংলাদেশের জন্য খুব উপকারী হবে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য, তাই এ–জাতীয় সুবিধাগুলো বাংলাদেশের পক্ষে বেশ কাজে লাগত।
দুর্ভাগ্যক্রমে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩-এর ২৭ জুন বাংলাদেশের জন্য জিএসপি স্থগিত করেছে এবং সেটি ২০১৩ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর কার্যকর করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ভবন ধসের পরে শ্রম অধিকার এবং সুরক্ষা–সম্পর্কিত সমস্যার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। রানা প্লাজা ভবনে বেশ কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানা ছিল। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে কমপ্লায়েন্সসংক্রান্ত কয়েকটি সমস্যা পূরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। তবে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাণিজ্য অগ্রাধিকার সম্প্রসারণ আইন ২০১৫-তে স্বাক্ষর করলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধাভোগী দেশগুলোর তালিকায় স্থান করে নিতে পারেনি। ২০১৫ সালের ২৯ জুন স্বাক্ষরিত আইনটি ৩১ জুলাই ২০১৩ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত অনেকগুলো দেশের জন্য জিএসপি সুবিধা অনুমোদন করেছে। জিএসপি সুবিধাভোগীদের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ যেমন আফগানিস্তান, ভুটান, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ছিল। ২০১৯-এর জুনে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য জিএসপি সুবিধা বাতিল করে।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা কাঠামো (টিকফা) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ আশা করেছিল যে এই টিকফা চুক্তি জিএসপি সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি মাধ্যম হতে পারে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র জিএসপিসহ বাণিজ্য ও শ্রমসম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছিল। তবে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১ শতাংশের কম পণ্যে জিএসপি সুবিধা দিয়েছিল। তৈরি পোশাক খাত যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য, সেটি জিএসপির আওতায় নেই। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে শুল্ক হিসেবে প্রায় ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ দিতে হয়। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা কাঠামো (টিকফা) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ আশা করেছিল যে এই টিকফা চুক্তি জিএসপি সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি মাধ্যম হতে পারে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র জিএসপিসহ বাণিজ্য ও শ্রমসম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছিল। তবে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
ইতিমধ্যে ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে কমপ্লায়েন্স আরও জোরদার করেছে। কমপ্লায়েন্স উন্নত করতে ক্রেতারাও তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের সহযোগিতায় বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন অগ্নি ও ভবননিরাপত্তা, শ্রমিকনিরাপত্তা, পরিচ্ছন্ন টেক্সটাইল ইত্যাদি উদ্যোগ। দেশের শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোসহ কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকারকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মীদের জন্য অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে তুলনীয় করার লক্ষ্যে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এখনো অনেক কিছু করা বাকি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য নীতি যা বাংলাদেশে প্রভাব ফেলবে তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মেগা বাণিজ্য চুক্তি বা ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের (টিপিপি) পুনরুত্থান এবং বাস্তবায়ন। এই বাণিজ্য চুক্তিটি ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে চুক্তিটি বাতিল করে। এই চুক্তির ১২টি সদস্যরাষ্ট্র বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ দখল করে আছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উরুগুয়ে রাউন্ডের পর টিপিপি ছিল বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তি।
নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর মাধ্যমে টিপিপি স্বাক্ষরকারী দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে প্রত্যাশা করেছিল। প্রাথমিক হিসাব করে বিভিন্ন সংস্থা বলেছিল যে টিপিপি চুক্তি ২০২৫ সালের মধ্যে টিপিপি সদস্যদের অর্থনীতি ২৮৫ বিলিয়ন ডলার বাড়াতে পারে। এদের মধ্যে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও নিউজিল্যান্ড তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারত। এই চুক্তির কারণে ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, টেক্সটাইল, নির্মাণ ও যন্ত্রপাতির উত্পাদন ও রপ্তানি এবং জাপানের পরিবহন সরঞ্জামের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি করা যেত।
টিপিপি চুক্তির ফলে বাংলাদেশে সম্ভাব্য বাণিজ্য বিচ্যুতি হতে পারে। নিজেদের মধ্যে ব্যাপক শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমে টিপিপি দেশগুলো টিপিপির বাইরে থাকা দেশগুলোর ওপর একধরনের প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। টিপিপির ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানি সরাসরি ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই চুক্তি বহাল হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তুলনায় ভিয়েতনামের তৈরি পোশাকের অনেক বেশি প্রাধান্য থাকবে। বাংলাদেশের অন্যান্য রপ্তানি পণ্য যেমন হিমায়িত খাদ্য এবং কৃষি পণ্যগুলোর বেলায়ও এটি সত্য।
ক্ষতির আরেকটি জায়গা হলো বিদেশি বিনিয়োগ। বিনিয়োগকারীদের জন্য টিপিপির সদস্যদেশগুলোতে বিনিয়োগ করা লাভজনক হবে। টিপিপি দেশগুলোতে তাদের রপ্তানি পণ্যে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, বিনিয়োগকারীরা যদি বিশ্ববাজারে রপ্তানি করতে ওষুধশিল্পে বিনিয়োগ করতে চান, তবে তাঁরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না।
অন্য দুটি ক্ষেত্র যেখানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবং প্রতিশ্রুতি প্রত্যাশা করে তা হলো কোভিড-১৯ অতিমারির ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে বিনিয়োগ এবং এই অতিমারি কাটিয়ে ওঠার জন্য ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে আসা। অতিমারি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশের জনগণের জন্য বিনা মূল্যে করোনা ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জো বাইডেন নির্বাচনের আগে মহামারি মোকাবিলার জন্য তাঁর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। আশা করি, তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে ভালো কিছু বেরিয়ে আসবে। একইভাবে প্যারিস চুক্তির প্রতি তাঁর সমর্থন জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য একটি ভালো খবর।
মোটকথা, বাইডেন সরকারের কাছে অনেক প্রত্যাশা। তবে একমাত্র সময়ই বলতে পারে সেগুলো কতটা বাস্তবায়িত হবে। এটি পরিষ্কার যে কোনো নীতিই বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া হয় না। এগুলো ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য মাথায় রেখে নেওয়া হয়। তাই বাংলাদেশের খুব বেশি আশা করার কোনো কারণ নেই।
ড. ফাহমিদা খাতুন নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
মতামত লেখকের নিজস্ব।