স্বস্তি-অস্বস্তির বাজেট – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in সমকাল on 7 June 2024

দেশের বিরাজমান আর্থসামাজিক বাস্তবতায় একটি সংযমী বাজেট দেওয়াটা ছিল অবধারিত। তাই প্রশমিত প্রবৃদ্ধির মাত্রা, সীমিত বিনিয়োগ, পরিমিত কর আরোপ এবং নিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রত্যাশিত।

তবে বর্তমান সমস্যাসংকুল ও জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কোনো আস্থাবর্ধক ও সুগ্রথিত কৌশল লক্ষ্য করা যায়নি। প্রচলিত বাজেট প্রস্তাবনায় যেন আটকে রইল স্বল্পমেয়াদি উন্নয়ন কৌশল। মনে হয়, নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতি সম্বন্ধে কিছুটা সচেতন হয়েছেন, কিন্তু পুরোটা উপলব্ধিতে নেননি। এটা একদিকে যেমন স্বস্তির, অন্যদিকে অস্বস্তির।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একদিকে বলা হচ্ছে, সংকোচনমূলক পদক্ষেপের কথা। সে ক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির হার কমে ৯ শতাংশ হবে এবং সরকার তার বাজেট ঘাটতির প্রায় ৫৫ শতাংশ মেটাবে ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আগামী বছর ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দেশজ আয়ের ২৭ শতাংশের ওপর, যা এ বছরের অর্জিত মাত্রার চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের অর্থায়নের এই হিসাব মেলানো কঠিন।

আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আগামী বছরের জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছে রপ্তানি বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশই থাকবে, রেমিট্যান্স আয়ের বৃদ্ধি হারের পতন হবে প্রায় ৩ শতাংশ। বৈদেশিক খাতের চলতি হিসাব কোনোক্রমে ইতিবাচক হবে না। অথচ এই রূপ সীমিত মাত্রার কার্যক্রমের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এই হিসাবও মেলানো কঠিন। তবে কি সরকার আগামী অর্থবছরে বিভিন্ন উৎস থেকে ব্যাপক পরিমাণ বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে বলে মনে করছে? সে ক্ষেত্রে দায়-দেনা পরিস্থিতির দক্ষ ব্যবস্থাপনা আগামী বছর আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সংখ্যাসমূহের মধ্যে সাযুজ্য কম পাওয়া গেলেও সরকার কর ভিত্তি সম্প্রসারণে বেশ উচ্চকণ্ঠ হয়েছে বাজেটে। কিন্তু এই বর্ধিত করের দুই-তৃতীয়াংশ আসবে পরোক্ষ কর থেকে। আমরা জানি, পরোক্ষ কর আয় নির্বিশেষে সবার ওপর বর্তায়। করযোগ্য আয়ের ন্যূনতম মাত্রা সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করা হয়নি। যদিও প্রান্তিক করের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক সমন্বয়ের সুবিধা বাজারে পাওয়া যাবে কিনা, তা দেখার বিষয়। তবে বিনা প্রশ্নে যে কোনো ধরনের টাকা বৈধ করার অনৈতিক সুযোগ সরকারকে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

শেষ বিচারে বরাদ্দের পরিমাণ যাই হোক না কেন, তার সুষ্ঠু ব্যবহার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমরা এখনও একটা ফলাফলভিত্তিক মূল্যায়ন কাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। আয় সম্পদের দক্ষ ও জনবান্ধব ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নকালে আমরা তা পাব?

লেখক : সম্মাননীয় ফেলো সিপিডি