প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে সাশ্রয়ীভাবে, সুশাসনের সঙ্গে, সময়ের মধ্যে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in বণিকবার্তা on 18 August 2024

রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বন্ধ ও ব্যয় সংশোধন প্রয়োজন

দেশের আলোচিত-সমালোচিত প্রকল্পগুলোর একটি ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কের ‘‌বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট’ বা বিআরটি। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি। নির্মাণকাজে নানা অব্যবস্থাপনার কারণে ভয়াবহ যানজট, জলাবদ্ধতা, একাধিক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, গার্ডার ধসে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে ব্যাপক জনদুর্ভোগের কারণ এ বিআরটি প্রকল্পটি। ভবিষ্যতে এটি যানজট নিরসন ও ঢাকায় উন্নত গণপরিবহন পরিষেবা কতটা দিতে পারবে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রকল্পটি পরিণত হয়েছে ভুল, ভোগান্তি ও ভবিষ্যতের বোঝায়।

পদ্মা সেতু ও ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের কারণে আমূল পরিবর্তন এসেছে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগে। এর মধ্যে একই গতিপথ বরাবর নতুন একটি রেলপথের নির্মাণকাজ চলমান। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে নির্মাণাধীন ঢাকা-যশোর রেলপথটির নির্মাণ ব্যয় ৩৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থার পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয়ে বাংলাদেশের এ রেলপথ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে থাকা এ প্রকল্পের গুরুত্ব ও সুফল নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

২২ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দৃষ্টিনন্দন একটি টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন টার্মিনাল ভবন হলেও তা ক্রমবর্ধমান যাত্রী চাহিদা পূরণে তেমন ভূমিকা রাখতে পারবে না। কারণ শাহজালাল বিমানবন্দরে কেবল একটি রানওয়ে। নতুন করে আরেকটি রানওয়ে তৈরির জায়গাও নেই। আকাশ পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন টার্মিনালটি যাত্রীদের কিছুটা উন্নত সেবা দিতে পারবে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান যাত্রীর চাপ সামাল দিতে ভূমিকা রাখতে পারবে না।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিক্ষা, গৃহায়ন, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রকল্প নেয়া হয়। প্রতি বছরের বাজেটেই প্রকল্পগুলোয় দিতে হয়েছে মোটা অংকের বরাদ্দ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) থাকা প্রকল্পের সংখ্যা ১ হাজার ৩২১। উন্নয়ন বাজেটের আকার ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদ ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান প্রকল্পগুলোর একটি বড় অংশ নেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। আবার এমন কিছু প্রকল্প রয়েছে যেগুলোর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কম। অস্বাভাবিক ব্যয়ের অভিযোগও রয়েছে একাধিক প্রকল্পে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিবেচনায় গৃহীত অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে নতুন করে যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বিগত সরকারের একাধিক প্রকল্প বর্তমানে ‘‌সাদা হাতি’তে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের সবচেয়ে বড় সাদা হাতির প্রকল্প হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এখানে রাশিয়ান ঋণে ১ লাখ ১৩ কোটি টাকা খরচ করে এ বিদ্যুৎ প্রকল্প করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর মাধ্যমে কত অর্থ লুটপাট হয়েছে তা বলাও এ মুহূর্তে কঠিন। কখনো যদি কোনো তদন্ত কমিটি হয় তাহলে হয়তো বের হবে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ, বিআরটিসহ অনেক প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত রিটার্ন পাওয়া যাবে না। অনেক প্রকল্প আন্ডার ইউটিলাইজড থাকবে। এগুলো তো হয়ে গেছে। এখন করার কিছু নেই। এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প যেন আর গ্রহণ করা না হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে সাবধান থাকতে হবে।’

এসব প্রকল্পের বিদেশী ঋণ দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে উল্লেখ করে ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘‌প্রকল্পগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ যখন শুরু হবে, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপদ নেমে আসবে। এরই মধ্যে বিপদ নেমে আসা শুরু করেছে। এ বিপদ কীভাবে কাটানো যায়, সেটা নিয়েই চিন্তাভাবনা করতে হবে। এটাই সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।’

বর্তমানে যেসব প্রকল্প চলমান, সেগুলো নতুন করে পর্যালোচনা করে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের মাথাপিছু ঋণের বোঝা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যে প্রকল্পগুলো চলমান আছে, বিশেষ করে মেগা প্রকল্প সেগুলো শেষ করাও কিন্তু এখন অনেক চ্যালেঞ্জিং। অতি প্রয়োজনীয় প্রকল্প ছাড়া অন্য প্রকল্পগুলোয় হাত দেয়া ঠিক হবে না।’

তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, প্রকল্প গ্রহণের আগে বলা হয়, সেটি আর্থিক ও বাণিজ্যিক দুই দিক থেকেই লাভবান হবে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেখা যায় সেটির ‌রিটার্ন খুবই দুর্বল, তখন বলা হয় আর্থসামাজিক উন্নয়ন করছি। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প এখন নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রকল্প নেয়ার আগে আর্থিক ও কারিগরি দিকগুলো যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে।’

প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পুরোটাই ঋণনির্ভর। রাজস্ব বাজেটে আমাদের কোনো উদ্বৃত্ত থাকে না। ফলে এডিপির পুরোটাই অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক ঋণে করা হয়। এ ঋণনির্ভরতার কারণে কিন্তু চাপও বাড়ছে। সুতরাং এখানে আমাদের অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করা দরকার। এরপর আমাদের অগ্রাধিকারগুলোকে পুনর্নির্ধারণ করা দরকার। সেখানে কোনটা বেশি প্রয়োজন, কোনটার অর্থায়ন কীভাবে হবে, অভ্যন্তরীণ নাকি বৈদেশিক দিয়ে হবে, এগুলোর একটা পর্যালোচনা জরুরি। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে সাশ্রয়ীভাবে, সুশাসনের সঙ্গে, সময়ের মধ্যে। এডিপি বাস্তবায়নের হার দ্রুততর করতে হবে।’