গত দেড় দশকে দেশে সৎভাবে ব্যবসা করার কোনো সুযোগ ছিল না – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 20 August 2024

অর্থনীতিতে অলিগার্কদের প্রভাব দূর করাই অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ

ক্ষমতার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলেফেঁপে ওঠা অল্প কিছু ব্যক্তির হাতে দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে তারা পরিচিতি পান অলিগার্ক হিসেবে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে বাজার নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত সবখানেই দেখা যায় তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি। গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রের অবাধ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছেন এমন বেশ কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী। দেশের অর্থনীতির বৃহদংশই তাদের ও তাদের মালিকানাধীন শিল্প গ্রুপগুলোর নিয়ন্ত্রণে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ অলিগার্কদের অনেকেই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছেন। গ্রেফতার বা সম্পদ ক্রোকের আতঙ্কেও রয়েছেন তাদের কেউ কেউ।

গত দেড় দশকে অলিগার্ক হিসেবে অর্থনীতিতে ব্যাপক মাত্রায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এমন ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন সালমান এফ রহমান (বেক্সিমকো গ্রুপ), মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদ (এস আলম গ্রুপ), মুহাম্মদ আজিজ খান (সামিট গ্রুপ), আহমেদ আকবর সোবহান (বসুন্ধরা গ্রুপ), মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম (ওরিয়ন গ্রুপ) ও মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার (নাসা গ্রুপ)।

এর মধ্যে সালমান এফ রহমান ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যানের পাশাপাশি আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। দেশের ওষুধ শিল্পের শীর্ষ কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের পাশাপাশি বস্ত্র, সিরামিকস, রিয়েল এস্টেট, নির্মাণ, ট্রেডিং, সামুদ্রিক খাবার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মিডিয়া, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ৩০টিরও বেশি কোম্পানি রয়েছে বেক্সিমকোর। গ্রুপটির অন্যতম কর্ণধার সালমান এফ রহমান শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে ১০ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।

তার বিরুদ্ধে সরকারের একজন মন্ত্রী সমমর্যাদার পদে থেকে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নীতি প্রণয়ন ও এর প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজের ব্যবসা সম্প্রসারণের অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে ব্যাংক চেয়ারম্যান হিসেবে এককভাবে ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়া ও নিজেই নামে-বেনামে ঋণ গ্রহণের অভিযোগও। দেশের ব্যাংক খাতে এখন বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের পরিমাণ অন্তত ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

আর্থিক খাতে বড় মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদেরও। দেশের অন্তত সাতটি বেসরকারি ব্যাংকের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, তার প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতাও। এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অন্তত দুই ডজনের বেশি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি ঋণ নেয়ার অভিযোগ আছে। ভোগ্যপণ্য আমদানির বাজারেও রয়েছে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। পাশাপাশি বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে বড় বিনিয়োগ রয়েছে গ্রুপটির। অভিযোগ রয়েছে, গভর্নর-ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে এস আলমের প্রভাব ছিল।

দেশের বিদ্যুৎ খাতের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের হাতে। বেসরকারি খাতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ১৮ শতাংশই এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে গ্রুপটি। এ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে মূলত গত দেড় দশকে। বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ বিভিন্ন খাতের অন্যতম প্রভাবক গ্রুপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ওবায়দুল করিমের ওরিয়ন গ্রুপ। এ গ্রুপের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে জানা গেছে।

ভূমি উন্নয়ন ও আবাসনসহ বিভিন্ন খাতের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আহমেদ আকবর সোবহানের বসুন্ধরা গ্রুপ। টানা ১৬ বছর ধরে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার। এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদেও রয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করা এ ছয় গ্রুপের ঋণের স্থিতি এখন ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। আর প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, তাদের মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষের।

অর্থনীতির পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতিতে অলিগার্কদের প্রভাব দূর করা এখন অন্তর্বতী সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। এজন্য সরকারকে চূড়ান্ত মাত্রায় সতর্ক ও পরিপক্ব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অবাধে সম্পদ আহরণের সুযোগ বহাল থাকলে আর্থিক খাত ও বাজার ব্যবস্থাপনার সংকটগুলো আগের মতোই বহাল থাকবে। আবার অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো বিবেচনায় না নিয়ে হঠকারী কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলে বাজার ধস, মূল্যস্ফীতির মতো সংকট প্রকট হয়ে ওঠারও জোর আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশের মতোই বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ক্ষমতার সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তাদের ফুলেফেঁপে ওঠার অনেক নজির পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে অর্থনীতিতে এখন পর্যন্ত শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার চেবলগুলোকেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। অর্থনীতিকে আমূল বদলে দেয়ার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও পরিকল্পনা থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এক সম্পদশালী গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন দেশটির সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পার্ক চুং-হি। ষাটের দশকে তার শাসনামলে ব্যক্তি খাতের পরিবারভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া হয় ভর্তুকি, প্রণোদনা, করছাড়, সহজ অর্থায়নসহ সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা। আবার এগুলোকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে পণ্য, সেবা, ব্যবস্থাপনাসহ ব্যবসার প্রতিটি অনুষঙ্গ নিয়ে নিয়মিতভাবে গবেষণা-উন্নয়ন চালিয়ে যায়, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়। জোর দেয়া হয় ব্যবসার সামাজিক ভিত্তি গড়ে তোলার ওপর।

এর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় গণ্ডি পেরিয়ে বৃহৎ আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যবসা সম্প্রসারণে উৎসাহ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় হয়ে ওঠা নিশ্চিত করে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। আর প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশটির অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ ও জনকল্যাণমূলক ভিত্তি গড়ে তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করে সরকারের নীতিমালা ও নজরদারি। এর সুবাদে ব্যবসার গণ্ডি বড় হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো রূপ নেয় বৈশ্বিক জায়ান্টে। পারিবারিক এসব ব্যবসা দক্ষিণ কোরিয়ায় পরিচিতি পায় চেবল (চে=সম্পদ, বল=গোষ্ঠী) হিসেবে। স্যামসাং, হুন্দাই, এলজি, লোটের মতো দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক বৈশ্বিক জায়ান্ট ব্র্যান্ডগুলোর প্রায় সবক’টিই সফল চেবলের উদাহরণ। দেশটির রফতানি আয় ও বৃহৎ পরিসরে কর্মসংস্থান তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে এ প্রতিষ্ঠানগুলোই। দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর অন্যতম করে তোলার পেছনে এসব প্রতিষ্ঠানকেই কৃতিত্ব দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি।

বিপদের সময়ে পাওয়া সরকারি নীতিসহায়তাকে অর্থনীতির জন্য লাভজনক বিনিয়োগে রূপ দিয়েছে চেবলগুলো। ১৯৯৭ সালের দিকে ব্যবসায়িক বিপর্যয়ে পড়ে দেশটির অন্যতম বড় চেবল হুন্দাই। সে সময় নীতিসহায়তা দিয়ে হুন্দাইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল দেশটির সরকার। ফলে বিপর্যয় কাটিয়ে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়ায় গ্রুপটি। হুন্দাই বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ২০০৯ সালে। তৎকালীন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে কয়েকজন উদ্যোক্তা ও তাদের প্রতিষ্ঠান বাজারে একচেটিয়া আধিপত্যের সুযোগ করে নেয়। সে সময় অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরা এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের অর্থনীতিতে চেবলের মতোই বড় ভূমিকা রাখবে প্রতিষ্ঠানগুলো।

কিন্তু গত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক পরিসরে দক্ষিণ কোরীয় চেবলগুলোর মতো বড় মাপের কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম দাঁড় করানো বা ‘বাংলাদেশী বহুজাতিকে’ রূপ নিতে পারেনি। বরং আইনি ও নীতিগত সুবিধা নিয়ে দেশের বাজার ও আর্থিক খাতের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। কারো কারো বিরুদ্ধে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অবাধে সম্পদ লুট ও বিদেশে পাচারেরও অভিযোগ এসেছে।

সাবেক অর্থ সচিব এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী মনে করেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রযোজ্য হবে না। কারণ কোরিয়ান ব্যবসায়ীদের স্বদেশপ্রেম ছিল। তারা বিদেশে সম্পদ পাচার করেনি। কিন্তু আমাদের ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর বড় অংশই বিদেশে অর্থ পাচারে অভিযুক্ত। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কারণে এটি ঘটেছে।’

মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘ভারতে আইন করে বলে দেয়া হয়েছে, করপোরেট জগতের লোকেরা ব্যাংকের পর্ষদে আসতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবসায়ী, ঋণদাতা, ঋণগ্রহীতা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সব ব্যাংকের মালিকানা ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। পুরো আর্থিক খাতেই একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরাধীদের অবশ্যই ধরতে হবে। আবার এটিও খেয়াল রাখতে হবে যাতে অর্থনীতি ধসে না পড়ে। প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’

আশির দশকে সীমিত পরিসরে ট্রেডিং ব্যবসার মধ্য দিয়ে করপোরেট জগতে হাতেখড়ি হয় মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদের। পরবর্তী সময়ে যিনি এস আলম হিসেবেই বেশি পরিচিতি পান। প্রতিষ্ঠা করেন এস আলম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিকাশের ধারায় থাকলেও গ্রুপটির ব্যাপক উত্থান দেখা গেছে গত দেড় দশকে। এ সময়ে দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রকদের একজন হয়ে ওঠেন এস আলম। আবার ব্যাংক খাতেও বিস্তার করেছেন একচেটিয়া আধিপত্য। গত এক দশকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ অন্তত সাতটি বেসরকারি ব্যাংকের। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা খাতেও আধিপত্য রয়েছে গ্রুপটির।

বর্তমানে এস আলম গ্রুপের অধীনে রয়েছে অর্ধশতাধিক কোম্পানি। ভোজ্যতেল, গম, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনের একচেটিয়া ব্যবসা রয়েছে গ্রুপটির। আবার ইস্পাত, সিমেন্ট, শিপিং, পরিবহন, পর্যটন, রিয়েল এস্টেট, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে এস আলমের। গ্রুপটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ১ লাখের বেশি কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন।

এস আলম গ্রুপের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে প্রতিষ্ঠিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এসএস পাওয়ার প্লান্ট নামে পরিচিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এস আলম গ্রুপ ও চীনের যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। কোম্পানির ৭০ শতাংশ মালিকানা বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপের এবং বাকি ৩০ শতাংশ চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রির। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৬০ কোটি ডলার।

এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংক ও গ্রুপটিকে বড় অংকের ঋণ দেয়া একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, এস আলম গ্রুপের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলোয় হাজার হাজার কোটি টাকার বেনামি ঋণ রয়েছে। এসব ঋণের সুবিধাভোগী এস আলম গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম দায়িত্ব হবে, বেনামি ঋণগুলো চিহ্নিত করে এস আলমের সিআইবিতে অন্তর্ভুক্ত করা। দেশে থাকা তার সম্পদকে সেসব ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে দেখাতে হবে। বিদ্যুৎ আমদানি বন্ধ করে এস আলমের বাঁশখালীর বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে উৎপাদনে রাখলে ব্যাংকের বেশির ভাগ ঋণই আদায় করা সম্ভব হবে।

দেশের বেসরকারি খাতের বৃহৎ করপোরেট গ্রুপগুলোর একটি বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড, যা সংক্ষেপে বেক্সিমকো গ্রুপ নামে পরিচিত। স্বাধীনতার পরের বছর গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা করেন দুই ভাই আহমেদ সোহেল এফ রহমান ও সালমান এফ রহমান। বস্ত্র, ওষুধ, সিরামিকস, রিয়েল এস্টেট, নির্মাণ, ট্রেডিং, সামুদ্রিক খাদ্য, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মিডিয়া, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও ব্যবসা রয়েছে গ্রুপটির। বেক্সিমকোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গ্রুপটিতে ৭০ হাজার কর্মী কাজ করছেন। গ্রুপটির বার্ষিক আয় ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিভিন্ন খাতে রয়েছে ৩০টির বেশি কোম্পানি। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি রফতানি খাতেও বড় দখল রয়েছে গ্রুপটির। বিশেষ করে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, শাইনপুকুর সিরামিকস, বেক্সিমকো সিনথেটিকস লিমিটেডের ব্যবসায়িক সফলতা বেশ ভালো। ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রেখে বেক্সিমকো গ্রুপের কাছ থেকে ব্যাংকের ঋণ আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে।

দেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রকদের একজন সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আজিজ খান। গত দেড় দশকে সামিট গ্রুপের ব্যবসার পাশাপাশি গ্রুপটির উদ্যোক্তাদের সম্পদ ফুলেফেঁপে বড় হয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিক ও অবকাঠামো খাতের ব্যবসা আছে সামিট গ্রুপের। সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের অধীনে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ ব্যবসার পাশাপাশি ভাসমান স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) এবং এলএনজি টার্মিনালসহ সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানি সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের মাধ্যমে বন্দর ব্যবসা, সামিট কমিউনিকেশনসের মাধ্যমে ফাইবার অপটিকসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসা এবং আবাসন খাতের ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে গ্রুপটির।

১৯৫৫ সালে জন্ম নেয়া মুহাম্মদ আজিজ খানের উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয়েছিল মাত্র ১৮ বছর বয়সে। বাবার কাছ থেকে নেয়া ৩০ হাজার টাকার পুঁজি দিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে ছাত্রাবস্থায় ১৯৭৩ সালে পুরান ঢাকায় জুতা তৈরির মাধ্যমে তার ব্যবসায় হাতেখড়ি। এসব জুতার একটি অংশ বাটা কোম্পানিকে সরবরাহ করতেন তিনি। জুতা তৈরির পাশাপাশি তিনি পিভিসি (পলি ভিনাইল ক্লোরাইড) আমদানিও শুরু করেন। এরপর তিনি শুরু করেছিলেন চিটাগুড় রফতানির ব্যবসাও। দুই যুগের বেশি সময় ধরে তিনি যুক্ত ছিলেন ট্রেডিং ব্যবসার সঙ্গে।

এরপর ১৯৯৭ সালে দেশের বেসরকারি খাতের শীর্ষ স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে প্রথম উৎপাদনে আসে সামিটের তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সে সময় কোম্পানিটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৩৩ মেগাওয়াট। ২০০৮ সালে এ সক্ষমতা দাঁড়ায় ১০৫ মেগাওয়াটে। মূলত ২০০৯ সালের পর থেকেই বিপিডিবির সঙ্গে একের পর এক বিদ্যুৎ বিক্রির চুক্তিতে আবদ্ধ হতে থাকে কোম্পানিটি। প্রথমে কুইক রেন্টাল পরে আইপিপি স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে থাকে সামিট পাওয়ার। গত এক দশকে বেসরকারি খাত থেকে বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ে সামিট পাওয়ারই প্রাধান্য পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কোম্পানির মুনাফা ও সম্পদের পরিমাণ। এ সময়ের মধ্যেই সিঙ্গাপুরে ব্যবসা চালানোর অনুমতি পায় সামিট গ্রুপ। বর্তমানে সামিটের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান জায়গা করে নিয়েছেন দেশটির শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায়। মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের সর্বশেষ প্রকাশিত সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীর মধ্যে আজিজ খানের অবস্থান ছিল ৪১তম। ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, তার মোট সম্পদ রয়েছে ১১২ কোটি ডলারের।

দেশে বর্তমানে সামিট গ্রুপের ১৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আছে। গ্রুপটির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২ হাজার ১৯৬ মেগাওয়াট। দেশের বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ১৮ শতাংশই সামিট গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

সামিট গ্রুপের মতোই দেশে বিদ্যুৎ খাতের বড় নিয়ন্ত্রক হলো ওরিয়ন গ্রুপ। গ্রুপটির ছয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৬১১ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ খাত ছাড়াও ওষুধ, কসমেটিক ও টয়লেট্রিজ, অবকাঠামো উন্নয়ন, আবাসন, প্রকৌশলসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে ওরিয়নের। গ্রুপটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বলা হয়, এ ঘনিষ্ঠতার সুবাদে দেশের বৃহৎ কোনো যোগাযোগ অবকাঠামোয় প্রথম বেসরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ওরিয়ন গ্রুপ। রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভারটি নির্মাণ হয়েছিল ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের মাধ্যমে।

ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের ১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানোর জন্য গতকালই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের প্রতি নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বহুবার সময় নিয়েও ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় এ নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোম্পানির ঋণের যথাযথ শ্রেণীবিভাগ করে আগামী ২২ আগস্টের মধ্যে সোনালী ব্যাংককে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোয় (সিআইবি) প্রতিবেদন পাঠাতেও বলা হয়েছে।

দেশের ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো বসুন্ধরা গ্রুপ। সিমেন্ট, পেপার, ইস্পাত, এলপিজি, ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে বসুন্ধরার। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছেন গ্রুপটির চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘গত দেড় দশকে দেশে সৎভাবে ব্যবসা করার কোনো সুযোগ ছিল না। গুটিকয়েক ব্যবসায়ী দেশে পণ্য আমদানি করতেন। আবার তারাই বেশি দামে পণ্য বিপণন করেছেন। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশের মানুষ তার সুবিধাভোগী হতে পারেনি। এখন সময় এসেছে বাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা তৈরি করার। তবে এটি করতে গিয়ে যাতে সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটিও দেখতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে নিজেই পণ্য আমদানির উদ্যোগ নিতে হবে।’

২০০৮ সাল থেকে টানা ১৬ বছর ধরে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার। দীর্ঘ সময় ধরে বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদেও রয়েছেন তিনি। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান নাসা গ্রুপের এ কর্ণধার শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে খাতটিতে ‘পরিবারতন্ত্র’ ও ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ তৈরিতে নজরুল ইসলাম মজুমদারের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। ব্যাংকগুলোর সিএসআর খাত থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে কম্বল আর শত শত কোটি টাকার অনুদান দেয়ার মাধ্যমে তিনি সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধ করে সুশাসন ফেরানোর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপই নেয়া হবে। এরই মধ্যে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে নজরদারি ও তদারকি বাড়ানো হয়েছে। আমদানি থেকে বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মূল্যের ব্যবধান কমানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’