শ্বেতপত্র তৈরি হলে উত্তরণের জন্য একটি পথনির্দেশিকা পাওয়া যাবে – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in প্রথম আলো on 23 August 2024

অর্থনীতির শ্বেতপত্রে ছয়টি বিষয় তুলে ধরবে কমিটি

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে যে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হবে, তাতে ছয়টি বিষয় থাকবে। সেগুলো হচ্ছে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা, বাহ্যিক ভারসাম্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এই কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করবে।

শ্বেতপত্র প্রকাশে গত বুধবার কমিটি গঠনের বিষয়টি জানায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। তারা বলেছে, শ্বেতপত্রে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন এবং স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় বিষয়ের প্রতিফলন থাকবে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে যে জটিল পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে, তাতে শ্বেতপত্র তৈরি হলে উত্তরণের জন্য একটি পথনির্দেশিকা পাওয়া যাবে। একদিকে পরিস্থিতির ভিত্তি, অন্যদিকে ইতিহাস—দুই দিক থেকেই কাজ করবে শ্বেতপত্র। এটি তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের পাশাপাশি মূল অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তা দেবে একধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি।

শ্বেতপত্রে যে ছয়টি ক্ষেত্রে আলোকপাত করা হবে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা। এতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ, সরকারি ব্যয় (সরকারি বিনিয়োগ, এডিপি, ভর্তুকি ও ঋণ) ঘাটতি বাজেট অর্থায়ন বিষয়াদি থাকবে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকবে উৎপাদন, সরকারি কেনাকাটা ও খাদ্য বিতরণ। আর বাহ্যিক ভারসাম্যে থাকবে রপ্তানি, আমদানি, প্রবাসী আয়, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি অর্থায়নের প্রভাব ও ঋণ।

অন্যদিকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের চাহিদা, জোগান, দাম নির্ধারণ, উৎপাদন ব্যয় ও ক্রয় চুক্তি; বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণের সুবিধা, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ও লজিস্টিকস, কর্মসংস্থান খাতে দেশি-বিদেশি, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক মজুরি এবং তরুণদের কর্মসংস্থান নিয়ে আলোকপাত করা হবে শ্বেতপত্রে।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’। এর প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পরামর্শ করে কমিটিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সদস্য মনোনীত করবেন।

কমিটির সদস্যরা হবেন অবৈতনিক। পরিকল্পনা কমিশন কমপ্লেক্সের কোনো একটি ভবনে হবে কমিটির দপ্তর। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। সরকারের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থা শ্বেতপত্র কমিটির চাহিদানুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করবে।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গত দেড় দশকে দেশের অর্থনীতি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জে পড়েছে। বিগত সরকারের চরম অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অর্থ পাচার এবং অপরিণামদর্শী প্রকল্পের নামে দেশি-বিদেশি ঋণ গ্রহণের কারণে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থা আছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, পতনের আগে শেখ হাসিনা সরকার ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ রেখে গেছে। এই হিসাব গত ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই অর্থ বাংলাদেশের তিনটি বাজেটের সমান। সে সরকার বাজেট–ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কর আদায়ের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টা না করে দেশি-বিদেশি ঋণের প্রতি ঝুঁকেছিল।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপির তুলনায় কর সংগ্রহ ১৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গত ছয়-সাত বছরে এই অনুপাত উল্টো ১১ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি দেশে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার একটি দিক। সামগ্রিকভাবে দুর্নীতি, অর্থ পাচারের অবাধ সুযোগ, বাজার সিন্ডিকেট ইত্যাদির ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়েছে।

শ্বেতপত্র–সংক্রান্ত প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, বিগত সরকারের সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নজিরবিহীন নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের অর্থনীতিকে সুসংহত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অর্থনীতি পুনরায় সচল করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো নিরসনে কাঠামোগত সংস্কার। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দূর, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানো, কর ও শুল্কনীতির সংস্কার এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ইত্যাদি চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে দেশের অর্থনীতির ওপর একটি সামগ্রিক চিত্র থাকা প্রয়োজন।

কমিটি গঠনের পর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার যে বিষয়টার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে, সে জন্য কৃতজ্ঞতা বোধ করছি। আমি মনে করি, দলিল হিসেবে থাকার জন্য আর্থিক অবস্থার ওপর একটা শ্বেতপত্র তৈরি হওয়া দরকার।’