Originally posted in প্রতিদিনের বাংলাদেশ on 30 August 2024.
অর্থনীতিবিদদের কড়া সমালোচনার পরও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখে প্রতি বছর দেশের জাতীয় বাজেট পাস হয়েছে। বিশ্লেষকরা নানা সময়ে বলেছেন, কালো টাকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আর্থিক প্রতারণা, তহবিল নয়ছয়, ঘুষসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি। এর ফলে সততা আর নৈতিকতার চর্চা ব্যাহত হয়। আর বিগত সরকার কালো টাকা বিনিয়োগের যে খাতগুলোর কথা বলেছিল সেগুলোও প্রবলভাবে দুর্নীতিবাজদের হাতে চলে গেছে।
এবার সেই সুযোগে লাগাম পড়েছে। অপ্রদর্শিত অর্থ হিসেবে বিবেচিত কালো টাকা বৈধ বা সাদা করার সুযোগ আর না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা শেষে এ তথ্য জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘অতি দ্রুত সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে।’
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ, নগদ টাকা এবং শেয়ারসহ যেকোনো বিনিয়োগ নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে ঢালাওভাবে সাদা করার সুযোগ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
এদিকে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯’ বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাদের সন্তানদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার সুবিধাটি আর থাকছে না। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, ‘আমাদের এই সরকারটা হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আউটকাম (ফসল)। নিরাপত্তা সংস্থা এরকম বিশেষ নিরাপত্তার দরকার আছে বলে মনে করে না। আর এটাকে বৈষম্যমূলক মনে করা হয়েছে, সেটার ভিত্তিতে এটা রহিত করা হয়েছে।’ বৈঠকে ‘বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফ) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়াও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রধান উপদেষ্টাকে নিরাপত্তা দেবে এসএসএফ। এর বাইরে হজের খরচ যাতে যৌক্তিকভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে বলে জানান পরিবেশ উপদেষ্টা।
কালো টাকা সাদা করা প্রসঙ্গ : অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহলের সমালোচনার পরও বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে তা বৈধ করার প্রস্তাব পাস করে সংসদ। সংসদেও সরকারি ও বিরোধী দলের অনেক সদস্য এর সমালোচনা করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন।
জুলাই থেকে এক বছরের জন্য কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ রাখা হয়। মাঝে এ সুযোগ বন্ধ রাখা হয়েছিল। এর আগে সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত শর্ত সাপেক্ষে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। পরের অর্থবছরে সেই সুযোগ আর রাখা হয়নি। একই সঙ্গে প্লট, ফ্ল্যাট ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও তুলে নেওয়া হয়।
একই সঙ্গে চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রশ্ন ছাড়া জমি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকলেও এলাকা অনুযায়ী বেঁধে দেওয়া কর অনুযায়ী সেগুলো বৈধ করা যাবে। এমন সুযোগ বৈধ করদাতাদের নিরুসাহিত করবে বলে তুলে ধরে বলা হচ্ছিল, এটি কর প্রদানের ক্ষেত্রে অসম ব্যবস্থার সূচনা করবে। অনেকে আর বৈধভাবে কর না দিয়ে পরে এ সুযোগ নেবেন।
কেননা একজন করদাতার ৩০ লাখ টাকা থাকলে ৩০ শতাংশের বেশি কর দিতে হচ্ছে। কিন্তু যিনি আগের বছরগুলোতে আয়করে যথাযথভাবে অর্থ প্রদর্শন করেননি তিনি ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সেই অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করে নিচ্ছেন। এতে নিয়মিত করদাতারা কর দিতে অনীহা দেখাতে পারেন।
এ ছাড়া কালো টাকা সাদা করার সুযোগে যেকোনো ব্যক্তি আয়কর আইন মেনে যেকোনো সময় নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করতে পারেন। তখন তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে। এতে দুর্নীতি উৎসাহিত হতে পারে বলেও অনেকের মত।
কালো টাকা সাদা হলে অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়ে তা নিয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মধ্যে সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অসৎ করদাতাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ করহারের সঙ্গে জরিমানা দিয়ে সীমিত সময়ের জন্য এই সুযোগ রাখা উচিত। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে এই সুযোগ তিন থেকে ছয় মাস রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা যাবে না। অর্থাৎ আবাসন খাত বা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে ছাড় দেওয়া হবে, এমন নিয়ম রাখা যাবে না। নিয়ম হতে হবে সোজাসাপটা। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের ক্ষেত্রে এই সুযোগ দেওয়া যাবে না। যারা সৎ পথে আয় করে আয়কর নথিতে তা প্রদর্শন করেননি, শুধু তাদের এই সুযোগ দেওয়া উচিত।’
সুযোগ দেওয়া হয়েছে ২২ বার : কালো টাকা সাদা করার সুযোগ চলতি অর্থবছরেই প্রথম দেওয়া হয়েছে এমনটি নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২২ বার দেওয়া হয়েছে এ সুযোগ। সময় মিলিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ছিল ৪০ বছর। এতবার সুযোগ দেওয়ার পরও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি বা দেশের অর্থনীতিতে তেমন ভূমিকা নেই কালো টাকার। সার্বিক অর্থনীতি বিবেচনায় সাড়াও মিলেছে সামান্য। কাউকে দেওয়া হয়নি সাজা।
ফলে প্রশ্ন উঠেছে সাড়া না পেলেও কাদের স্বার্থে বারবার দেওয়া হয়েছে এ সুযোগ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, মূলত এর মাধ্যমে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে কালো টাকার মালিকদের সিন্ডিকেট বড় হয়ে গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা ১৫ শতাংশ কর দেওয়াকেও অপচয় মনে করেছেন।
এনবিআরের হালনাগাদ তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সাদা করা হয়েছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির তথ্য বলছে, গত ৫০ বছরে দেশে কালো টাকার পরিমাণ ১৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর দেশের বাইরে পাচার হয়েছে ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ কালো টাকা ও পাচার হওয়া টাকার মোট পরিমাণ ১ কোটি ৪৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ কালো টাকা সাদা হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ।
এনবিআর সূত্র জানায়, ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কালো টাকা সাদা হয় ২ কোটি ২৫ লাখ। এতে রাজস্ব আদায় হয় মাত্র ১৯ লাখ টাকা। এরপর ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সাদা করা হয় ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। রাজস্ব আদায় হয় ৮১ লাখ টাকা। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাদা হয় ৪৫ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় হয় ৫৯ লাখ টাকা। এরপর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাদা হয় ১৫০ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা। ৯৫০ কোটি টাকা আদায় হয় ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। এই তিন বছরে আদায় হয় ১৪১ কোটি টাকার রাজস্ব।
২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সাদা করা হয় ৮২৭ কোটি টাকা। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। প্রকাশ করেছিল সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা। ওই বছর ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালে প্রায় ৩২ হাজার করদাতা ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা সাদা করেন। তখন কালো টাকা সাদা না করলে শাস্তির কথা বলা হয়েছিল। মূলত ভয়েই তখন এত মানুষ সুযোগটি নেন।
এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সাদা করা হয় ১ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় হয় ২৩০ কোটি টাকা। ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সাদা হয় ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় হয় ১ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৮৫৯ ব্যক্তি টাকা সাদা করেন। অর্থের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। মূলত করোনার কারণে দেশের বাইরে পাচার করতে না পারায় বিপুল পরিমাণ অর্থ সাদা করা হয় বলে মত এনবিআর কর্মকর্তাদের।
২০২১-২২ অর্থবছরে টাকা সাদা করেন ২ হাজার ৩১১ জন। অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেউ টাকা সাদা করেননি বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব চূড়ান্ত করেনি এনবিআর। এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে ২০০৯-২৩ পর্যন্ত প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা সাদা করেছেন অবৈধ টাকার মালিকরা।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগটি ছিল অনৈতিক। এর মাধ্যমে অবৈধ পথ বা দুর্নীতিকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বৈধ পথে অর্থ উপার্জন নিরুৎসাহিত করা হচ্ছিল। এ ছাড়া কালো টাকা সাদা করতে গিয়ে ট্যাক্স হার নির্ধারণেও বৈষম্য করা হয়েছে। যারা বৈধ পথে আয় করবেন তারা বেশি ট্যাক্স দেবেন, আর অবৈধ টাকা বৈধ করতে কম ট্যাক্স দিতে হবে এমন বৈষম্য গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের নীতি থাকতে হবে সমতাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।’
ট্যাক্স হার বেশি ধরে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, কোনো উপায়েই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া যাবে না। বরং এসব অর্থ খুঁজে বের করে জব্দ করতে হবে।’
৫০ দেশে আছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ : শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের মোট ৫০টি দেশে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করেনি কোনো দেশ। ওইসব দেশে সীমিত সময়ের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এবং সুযোগ লুফে না নিলে শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে বারবার সুযোগ দেওয়ার কারণে দুর্নীতিবাজরা মনে করেন ভবিষ্যতেও এ সুযোগ পাওয়া যাবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমে বলেন, ‘বারবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সমাজ একটি বার্তা দেয় যে, তুমি দুর্নীতি করো, আমি বৈধ করে দেব। রাজস্ব বাড়ানোর খোঁড়া যুক্তিতে দুর্নীতি ও অনৈতিকতার গভীরতা ও ব্যাপকতার বিকাশকে স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হচ্ছে। দুর্নীতিকে লাইসেন্স দেওয়ার এ প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ হবে, এটিই প্রত্যাশিত।’