Originally posted in বণিকবার্তা on 5 September 2024
বরাদ্দ ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোযোগের আহ্বান বিশেষজ্ঞদের
দেশের জীবনরেখা কৃষি
দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ এখনো খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে অন্তত একজন খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার শিকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ পরিস্থিতিকে সঙ্গিন করেছে ডলার সংকট ও মূল্যস্ফীতি। চাপে পড়েছে কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তা।
বর্তমানে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় চারটিসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ঘটে যাওয়া বন্যা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আসন্ন বোরো ও রবি মৌসুম সামনে রেখে প্র য়োজনীয় সারের জোগান নিশ্চিত করার বিষয়টি। এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহ ঠিক রাখাকে দেখা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় অন্তর্বর্তী সরকারকে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবদিরা। একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে সার উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়েও মনোযোগ দিতে বলেছেন তারা।
দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খাদ্যশস্যটির উৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি হারের নিচে নেমে গেছে। বিষয়টি খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, গত তিন অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। যদিও বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে বার্ষিক জনসংখ্যা স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার (আরএনআই) ছিল ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা আগের বছরে ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া আন্তঃশুমারি গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ।
চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এ মাত্রায় শ্লথ হয়ে আসার পেছনে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন আবাদি জমি হ্রাস ও কৃষিতে নতুন জনশক্তি যুক্ত না হওয়াকে। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো, কৃষি খাতে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও ধানের কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়ায় কৃষক অন্য ফসলে ঝুঁকছেন। আবার কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের গতিকে ধীর করে তুলছে ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতা। এ অস্থিরতার কারণে যান্ত্রিকীকরণে উৎপাদন ব্যয় কমার কথা থাকলেও সে সুযোগ নিতে পারছেন না কৃষক। এ অবস্থায় কৃষি ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকেই।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। আগের অর্থবছরেও দেশে একই পরিমাণ চাল উৎপাদন হয়েছিল। সে অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্য। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে খাদ্যশস্যটির মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮৯ লাখ টনে। প্রবৃদ্ধির হার ছিল দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র দশমিক ২৬ শতাংশ বেড়ে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৯০ লাখ টনে। প্রতিবারই দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম।
কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি ভর্তুকি ও প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া চালের উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির প্রভাবে যন্ত্রপাতির আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ফলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গতি কম। এটি দ্রুত হওয়া উচিত। আবার ধান উৎপাদনের ব্যয়ও বেড়েছে। সেচ ব্যয় বেড়েছে। ৬৫ শতাংশ কৃষক এখনো সেচের জন্য পেট্রলের ওপর নির্ভরশীল। তাই এখানে ভর্তুকি বাড়াতে হবে।’
কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ ও বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘গড়ে সাড়ে ৪ শতাংশ হারে প্রতি বছর কৃষি উৎপাদন না বাড়াতে পারলে মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। সেজন্য এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আর ইউরিয়া সার আমদানির পরিবর্তে নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এখন আমরা মাত্র ১০ লাখ টনের মতো উৎপাদন করে থাকি। বড় তিনটি কারখানার মধ্যে একটি চালু আছে। বাকি দুটি কারখানা চালু রাখতে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এসব কারখানা চালুর মাধ্যমে উৎপাদন সক্ষমতা উন্নীত করতে হবে ২০-২৫ লাখ টনে।’
২০৩০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। ২০২১ সালে ‘ডাবলিং রাইস প্রডাক্টিভিটি’ (ডিআরপি) শীর্ষক একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে প্রতিষ্ঠানটি। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার মাধ্যমে উৎপাদন ৪ কোটি ৬৯ লাখ টনে নেয়া সম্ভব বলে জানানো হয়।
কৃষিজমি হ্রাস ও তরুণদের কৃষিতে অনাগ্রহের কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চালের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এমএ সাত্তার মন্ডল। এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে প্রতি বছর কৃষিজমি কমছে। তরুণরাও আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে কৃষকের সংখ্যাও কমছে। এতে চালের উৎপাদন বাড়িয়ে দ্বিগুণে তোলার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। যদিও কৃষিতে উন্নত থেকে উন্নততর প্রযুক্তি এবং নতুন নতুন জাতও আসছে। আর তরুণ উদ্যোক্তারাও মাছ বা অন্য ফসলের চাষ করছেন। তারা রফতানির কথা মাথায় রেখে আলু, ভুট্টা, গম ও টমেটো বা অন্য ফলন চাষ করছেন। রবিশস্যের জমিতে তিল বা সরিষা চাষ হচ্ছে। তাহলে কি আমরা অর্থকরী ফসল রফতানি করে চাল আমদানি করব? হয়তো তরুণরা বাণিজ্যিক কৃষিতে আসবেন, তবে তারা ধান চাষে যাবেন না। আর প্রান্তিক কৃষক হয়তো খোরপোষ বজায় রাখার জন্য কোনোমতে টিকে থাকবেন। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধানের উৎপাদন বাড়বে না।’
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে উন্নত বীজে জোর দেয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। লাল তীর সিড লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কৃষিকে লাভজনক করার জন্যই বেশি ফলন দেয়া বীজ উন্নত করতে হবে। তাতে কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ের জন্যই লাভ হবে। পাশাপাশি লবণ ও তাপসহনীয় জাত নিয়ে আসতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ছাড়া কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই এখন। যেমন পেঁয়াজের উন্নত বীজ সারা দেশে ছড়িয়ে দিলে পেঁয়াজ আমদানি করা লাগবে না। অন্যান্য ক্ষেত্রেও একইভাবে উচ্চফলনশীল জাত নিয়ে আসতে হবে।’
বিবিএসের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, দেশের ২১ দশমিক ৯২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এদের মধ্যে গ্রামে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। শহরে এ হার ২০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম সিটি করপোরেশন এলাকায়, ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে ১৮ শতাংশ মানুষ। আর ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার মানে, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছে, তারাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছে।
বিবিএসের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, শ্রেণীভিত্তিক বিভাজনে অতিদরিদ্রদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ৭০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দরিদ্রদের মধ্যে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। মধ্যবিত্তদের মধ্যে এ হার ১৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ধনীদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে ১ দশমিক ১১ শতাংশ।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. কাজী মো. রেজাউল করীম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘খাদ্যের জোগান থাকার পরও প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে না পারলে তাকে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বলা হয়। এখন আগের চেয়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। আয় করার পরও মানুষ হয়তো জিনিসের দাম বাড়ার কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারছে না। ক্রয়ক্ষমতা না থাকায় মাংসের বদলে হয়তো মানুষ ডিম খাচ্ছে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে ১৮ শতাংশ মানুষ আর ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছে তারাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ছে। স্বল্প আয়ের চাকরিজীবীদেরও ক্রয়ক্ষমতার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। তারা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এমনকি মধ্যবিত্তরা টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে নিত্যপণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে।’