বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি সরকারকেও আমদানির প্রস্তুতি নিতে হবে – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in প্রথম আলো on 14 October 2024

নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির

আগস্টের মাঝামাঝি দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যায় কৃষিপণ্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ঘাটতি মোকাবিলায় পণ্য আমদানি স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়ার কথা। কিন্তু ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ না থাকায় নিত্যপণ্যের আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে।

পণ্য আমদানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, একদিকে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায় মন্দা, অন্যদিকে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এ অবস্থায় বেশি দরে পণ্য এনে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ফলে চাহিদা থাকলেও তাঁরা যথেষ্ট পরিমাণে নিত্যপণ্য আমদানির পথে যাচ্ছেন না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুই মাসে (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) ভোজ্যতেল, চিনি ও পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের আমদানি কমে গেছে। বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দামও বাড়ছে। ফলে সরবরাহ না বাড়লে সামনে এসব পণ্যের ঘাটতির শঙ্কা রয়েছে।

আমদানি কমায় নিত্যপণ্যের সরবরাহে চাপ তৈরি হয়েছে। তাতে ময়দা, সয়াবিন তেল, পাম তেল ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব পণ্যের দাম ১ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ বেড়েছে। চিনির শুল্ক কমানোর কারণে দাম কেজিপ্রতি তিন টাকা কমেছে। যদিও প্রতি কেজি চিনিতে কমবেশি ১১ টাকা শুল্ক–কর কমানো হয়েছে। এর প্রধান কারণ, চিনির সরবরাহ কম।

বিগত সরকারের আমলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যায়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের গত দুই মাসে নিত্যপণ্যের দাম কমেনি; বরং বেড়েছে।

আমদানি কেন কমছে

আমদানি কমে যাওয়া নিয়ে প্রথম আলো শীর্ষ ও মাঝারি পর্যায়ের পাঁচজন আমদানিকারকের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে অস্থিরতার কারণে ব্যবসায় মন্দাভাব রয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সময় নিয়েছেন তাঁরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারের কোনো দিকনির্দেশনাও পাচ্ছেন না। আবার ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলা নিয়ে সমস্যা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। ফলে আমদানিনির্ভর পণ্যের সরবরাহ কমছে।

আমদানি কেন কমছে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে পাম তেলের দাম বাড়তে থাকায় এ পর্যন্ত সংগঠন থেকে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ৬ অক্টোবর উপদেষ্টার কাছে চিঠি দেওয়া হয়। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় মূল্য সমন্বয়ের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি না হওয়ার কথা তুলে ধরা হয় চিঠিতে। এ জন্য ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন বলে জানানো হয়। কিন্তু সরকারের দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা আমদানিতে নিরুৎসাহিত হয়েছেন।

নিত্যপণ্যের আমদানিকারক সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঋণপত্র খোলার আগে দেশে পণ্য আমদানিতে কত খরচ পড়বে এবং স্থানীয় বাজারে দাম কত, তার হিসাব করে পণ্য আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। বিশ্ববাজারে এখন যে দাম, সে তুলনায় দেশের বাজারে পণ্যের দাম কম। আবার ব্যাংকের সুদের হার বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোগ্যপণ্যে বিনিয়োগ কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক।

দুই মাসের চিত্র

এনবিআরের হিসাবে দেখা যায়, নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে চিনির কাঁচামাল অপরিশোধিত চিনির আমদানি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আগস্ট-সেপ্টেম্বর—এই দুই মাসে চিনি আমদানি হয় দুই লাখ টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ২৮ হাজার টন। এ হিসাবে আমদানি কমেছে ৩৭ শতাংশ।

পাম তেলের আমদানি কমেছে। সয়াবিনের আমদানি কিছুটা বাড়লেও দুই ভোজ্যতেল মিলে চাহিদার তুলনায় আমদানি কম। এনবিআরের হিসাবে, গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এই দুই ধরনের তেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৪৯ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয় ৩ লাখ ৭৬ হাজার টন। এ হিসাবে আমদানি কমেছে ৭ শতাংশ।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পেঁয়াজও আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজ আমদানি হয় ৯৪ হাজার টন, যা গত বছর একই সময়ে হয়েছিল ২ লাখ ৩০ হাজার টন। আমদানি কমেছে ৫৯ শতাংশ।

অবশ্য গম আমদানি কমেনি। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে গমের আমদানি হয় ১০ লাখ ৭৫ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে ছিল ১০ লাখ ৭০ হাজার টন। নিত্যপণ্যের মধ্যে আমদানি বেড়েছে মসুর ডালের। গত দুই মাসে ১ লাখ ১৯ হাজার টন মসুর ডাল আমদানি হয়, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৩৭ হাজার টন। এ হিসাবে মসুর ডালের আমদানি দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। মূলত গত দুই মাসে যেসব পণ্য আমদানি হয়েছে, সেগুলোর বড় অংশের ঋণপত্র আগেই খোলা হয়েছিল।

তবে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাহিদা কমার কারণে নিত্যপণ্যের আমদানি কিছুটা কমেছে। আবার চিনি চোরাচালান বেড়ে যাওয়া চিনি আমদানি কমার প্রধান কারণ। তবে এখন চোরাচালান কিছুটা কমেছে। এখন আবার আমরা আমদানি বাড়াচ্ছি।’

দাম বাড়ছে

নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পাম তেলের দাম। টিসিবির হিসাবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে খোলা পাম তেলের দাম ছিল প্রতি লিটারে ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা। শনিবার পাম তেল বিক্রি হয়েছে ১৪৪ থেকে ১৪৫ টাকায়। এই হিসাবে প্রতি লিটারে ১০-১৯ টাকা বেড়েছে। ভোজ্যতেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পাম তেল। এই তেলের দাম বাড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়ছে। আবার খাদ্যপণ্য শিল্পের উপকরণ তৈরির খরচও বাড়ছে।

পাম তেলের পাশাপাশি সয়াবিন তেলেরও দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি সাত টাকা। ৪ আগস্ট সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি লিটারে ১৪৪-১৪৫ টাকা। এখন তা সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বোচ্চ ৭ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৫২-১৫৬ টাকা।

পেঁয়াজের দামও মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। ৪ আগস্ট প্রতি কেজি আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ১০০-১০৫ টাকা। তবে এখন পেঁয়াজের দামও বেড়েছে। টিসিবির হিসাবে প্রতি কেজি পেঁয়াজ এখন বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়।

টিসিবির হিসাবে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্যাকেটজাত ময়দার দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। তবে আটার দাম এখনো আগের মতো রয়েছে। চিনির দাম আগের তুলনায় কেজিপ্রতি তিন টাকা বেড়েছিল। তবে শুল্ক কমানোর কারণে দাম কমে ৪ আগস্টের দরে থিতু হয়েছে।

সরকারের নানা পদক্ষেপ

পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। সর্বশেষ চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ১৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। তাতে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনিতে শুল্ক–কর ১১ টাকা ১৮ পয়সা কমবে বলে এনবিআর জানিয়েছে। প্রতি কেজি চিনিতে শুল্ক–কর দিতে হতো ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। এখন দিতে হবে ২৭-৩১ টাকা। ভোজ্যতেলের শুল্ক–কর আগেই কমানো হয়েছে। এরপরও প্রতি কেজিতে ১৭-১৮ টাকা শুল্ক–কর দিতে হচ্ছে।

তবে আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুল্ক–কর কমানোর চেয়ে সরবরাহ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন গবেষকেরা। তাঁরা মনে করেন, সরবরাহ না বাড়লে সংকট কাটবে না।

জানতে চাইলে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, আগস্টের বন্যায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে চাপ রয়েছে। আমদানি পণ্যেও চাপ বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে আমদানি কমে গেলে ঘাটতি বাড়বে। শুধু শুল্ক–কর কমানোর মতো বাজার ব্যবস্থাপনা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি সরকারকেও আমদানির প্রস্তুতি নিতে হবে। না হলে খাদ্যসংকটের শঙ্কা থেকে যাবে।

গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, এ পরিস্থিতিতে বাণিজ্য, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে উৎপাদন ও চাহিদার হিসাব প্রাক্কলন করে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে ঘাটতি কত হবে এবং তা কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।