Originally posted in সমকাল on 2৯ October 2024
সিপিডি-সমকাল গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
তরুণ ও স্থানীয়দের যুক্ত করতে হবে বন্যা ব্যবস্থাপনায়
এবার দেশের পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যা নতুন করে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে স্থানীয় মানুষ ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্যার বহুমুখী প্রভাব মোকাবিলায় সহযোগিতা কাঠামোতেও পরিবর্তন দরকার। পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণে বাজেট বৃদ্ধি, সুষম বণ্টন, সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান, বীমা চালু, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদান, জলযানের ব্যবস্থা, সঠিক তথ্যভান্ডার তৈরি, বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বন্যাসংক্রান্ত পূর্বাভাস সহজবোধ্য করতে হবে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশের বন্যা: জীবন, জীবিকা ও অর্থনীতিতে প্রভাব এবং করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এই অভিমত তুলে ধরেন। যৌথভাবে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও দৈনিক সমকাল।
বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান। সভাপতিত্ব করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সমকালের সহযোগী সম্পাদক ও সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান শেখ রোকন।
বক্তারা বলেন, ‘সবকিছু করে ফেলেছি, সবকিছু হয়ে গেছে– এমন আত্মতৃপ্তিতে ভোগা যাবে না; পূর্বাঞ্চলের বন্যা দেখে সেটাই মনে হয়েছে। বন্যা বা দুর্যোগের কারণে একজন মানুষও যেন কষ্ট না পান। বন্যা ব্যবস্থাপনা নিতে হবে স্থানীয় মানুষের মতামতের ভিত্তিতে।’
পানিসম্পদ সচিব নাজমুল আহসান বলেন, ‘এবারের বন্যা আমাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। একে মাথায় রেখেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করছি। আবহাওয়ার পূর্বাভাস যে ভাষায় দেওয়া হয়– তা এখনও জনবান্ধব হয়ে ওঠেনি, অনেকেই এটি বুঝতে পারেন না। তাই বন্যা পূর্বাভাস আরও সহজ করার পদক্ষেপ নেব।’ গুগল নোটিফিকেশনের বিষয়ে চিন্তা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এসএমএস সিস্টেমের মাধ্যমে সতর্কীকরণ বার্তা মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছি। বিভাগ অনুযায়ী বার্তা দিচ্ছি।’
নাজমুল আহসান বলেন, ‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বন্যার পানি নামার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ রকম ভয়াবহ বন্যা আরও হতে পারে। এ জন্য আমাদের আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রতিটি কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। স্থানীয়দের মতামত নিয়েই পরিকল্পনা ও প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। তরুণদের সম্পৃক্ত করে কাজ করছি।’ তিনি জানান, আগামী ১ নভেম্বর জাতীয় যুব দিবসে তরুণরা ৬৪ জেলায় ৬৪টি এবং ঢাকায় দুটি খাল পরিষ্কার করবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যুবক-তরুণদের কাজে লাগানো। এতে সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহি বাড়বে। সচিব বলেন, ‘বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ব্যবস্থাপনা যুগোপযোগী করার চেষ্টা করছি। নাব্য রক্ষায় নিয়মিত নদী ড্রেজিং হচ্ছে। পানি প্রবাহের জায়গা যেন নষ্ট না হয়, তার জন্য নিয়মিত কিছু কাজ করতে হবে। টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট বা জোয়ারাধার (টিআরএম) পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেসব অঞ্চল টিআরএমের উপযোগী, সেখানে এই পদ্ধতিতে যাব।’ সম্প্রতি যশোরের ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতা নিরসনে টিআরএম চালু হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সিপিডির প্রধান নির্বাহী ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দুর্যোগ বেড়ে চলেছে। প্রথম যখন বন্যার ঢেউ আসে তখন জীবন ও ঘরবাড়ির ওপর প্রভাব পড়ে। তারপর মানুষের জীবিকা বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলে মধ্যমেয়াদি থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বন্যার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি বছর বছর বাড়ছে। এ ছাড়া প্রাণহানিসহ বন্যার বহুমুখী প্রভাব আছে।’ তিনি বলেন, ‘এবার সবাই সমানভাবে ত্রাণ পায়নি, সমন্বয়ের অভাব ছিল। কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সহায়তা বেশি পেয়েছে, কোথাও কম পেয়েছে। পূর্বাঞ্চলে বন্যার সতর্কীকরণও আগে থেকে হয়নি। বাঁধগুলো ফের তৈরি করে শক্তিশালী করতে হবে। জিনিসপত্র ও অর্থ– দুটিই বন্যার্তদের প্রয়োজন। বিশেষ করে জীবিকার জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ জীবিকার সন্ধানে পুরুষরা অন্যত্র চলে যায়। তখন নারী ও শিশুদের ওপর বড় প্রভাব পড়ে।’ তাঁর মতে, বন্যায় ক্ষতি কমাতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। বন্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণও বাড়াতে হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা বলেন, ‘প্রচুর ত্রাণ থাকলেও নৌকার অভাবে দুর্গম এলাকায় তাৎক্ষণিক ত্রাণ দেওয়া যায়নি। ফলে হেলিকপ্টারে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। সামনে জেলায় জেলায় নৌকা সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।’ বন্যা মোকাবিলায় তরুণদের সম্পৃক্ত করে সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘বন্যার ঝুঁকি মোকাবিলায় বীমা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। তবে দুর্যোগের পূর্বাভাস ও সতর্ক বার্তা জনবান্ধব করা দরকার।’ নতুন আশ্রয়কেন্দ্রে নারী-শিশুদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘সমন্বয়হীনতার কারণে দেশে অনেক কাজ সঠিকভাবে হয় না। তাই সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তি খাত সেভাবে আসছে না, এটি দেখা দরকার।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. খুরশিদ আলম বলেন, ‘বাজেট ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন করতে হবে। এটা করা গেলে বাজেটের নামে লুটপাত বন্ধ হবে। নিয়মিত বাজেটের সঙ্গে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার ইমার্জেন্সি বাজেট রাখতে হবে।’
ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রেই জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সবার সম্পৃক্ততা দরকার।’
লেখক, গবেষক এবং দুর্যোগ ফোরামের আহ্বায়ক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় এবার তরুণরা এগিয়ে এসেছে। কিন্তু তরুণদের গাইড করার মতো কেউ ছিলেন না। ফলে সহায়তা কেউ পেয়েছেন, কেউ পাননি। সিভিল সোসাইটি যতটা টেলিভিশনে সোচ্চার ছিল, ততটা মাঠে ছিল না।’ তাঁর মতে, বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি অনেক ভালো হয়েছে বলা হলেও আসলে এটা বইয়ের কথা। প্রস্তুতি ভালো হলে আমাদের ৫৩ বছর আগের সতর্কীকরণ বার্তা দিয়ে চলতে হতো না। তিনি বলেন, ‘আমাদের টাকা আছে কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। যেমন- যার জমি আছে, তাকে কৃষিঋণ দেওয়া হচ্ছে, অথচ বন্যায় হয়তো তাঁর কোনো ক্ষতিই হয়নি।’
সমুদ্রবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, ‘বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমরা বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান পাই না। সেটি কারা করবে? এ সম্পর্কে ধারণা রাখা ব্যক্তিকে আমরা সঠিক জায়গায় বসিয়েছি কিনা, সেটা দেখা জরুরি।’
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র এনভায়রনমেন্টাল স্পেশালিস্ট ড. ইশতিয়াক সোবহান বলেন, ‘আমরা সাধারণত প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে বন্যা মোকাবিলার চেষ্টা করি। কেন ফেনীতে বন্যা হলো, ফেনী তো সমুদ্রের পাড়েই! আমরা আসলে ফ্লাডপ্লেইন নষ্ট করে দিচ্ছি।’
রিভারাইন পিপলের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এফএম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রভাবশালীরা নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে। ফলে অনেক জায়গায় নদীর পাশ দিয়ে পানি বেরিয়ে যাওয়া পথগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।’
গ্লোবসাইটের ফেলো রিফাত জাবীন খান বলেন, ‘বন্যা মোকাবিলায় তরুণদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা ঠিক করতে হবে।’
শেখ রোকন বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘শত শত বছর ধরে আমরা বন্যার সঙ্গে বাস করে আসছি। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বন্যা আমাদের জীবন, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য স্মৃতি। এ বছর দেশের তিন দিকে তিনটি বন্যা হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় নাগরিক সংগঠনগুলো বন্যা নিয়ে এবার অনেক সক্রিয় ছিল। প্রশাসন, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা, সাহায্য সংস্থা, এনজিওর বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে নানা আলোচনা হয়েছে।’