নিম্ন ও নিন্মমধ্যবিত্ত শ্রেণীকে স্বস্তি দিতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আরো সম্প্রসারিত করা উচিত – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 17 November 2024

অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ

জনবিমুখ নীতি থেকে সরে জনমুখী অর্থনীতির দিকে যাত্রা শুরু হয়নি

টিসিবির ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির পয়েন্টগুলোয় প্রতিদিনই বাড়ছে মানুষের ভিড় ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

রাষ্ট্রের নাগরিকদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সুরক্ষা, মৌলিক সেবার নিশ্চয়তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সর্বোপরি বৈষম্য প্রশমনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণীত বাজেটগুলো পরিচিত জনকল্যাণমুখী বাজেট হিসেবে।

রাষ্ট্রের নাগরিকদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সুরক্ষা, মৌলিক সেবার নিশ্চয়তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সর্বোপরি বৈষম্য প্রশমনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণীত বাজেটগুলো পরিচিত জনকল্যাণমুখী বাজেট হিসেবে। বাংলাদেশের মানুষ জনকল্যাণমুখী বাজেট থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। এখানে বাজেট মানেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে জনগণের অর্থের যথেচ্ছ তছরুপ। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটটিও এর ব্যতিক্রম নয়। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফলে গণবিরোধী এ বাজেট কাঠামো পরিবর্তনের সুযোগ ছিল। যদিও অভ্যুত্থানের ১০০ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের দেয়া বাজেটই বহাল রয়েছে। একইভাবে বহাল রয়েছে বিগত সরকারের গৃহীত রাজস্ব ও মুদ্রানীতিও। কিছু জায়গায় ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতির দর্শন ও ব্যবস্থাপনায় কোনো পরিবর্তন হতে দেখা যায়নি। বরং বৈষম্য বিলোপের ডাক দিয়ে একটি অভ্যুত্থান সফল হলেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় তা দূর করার কোনো উদ্যোগ এখনো নেয়া হয়নি।

শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৮৮ শতাংশ। ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশের কাছাকাছি। অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দামও। জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা এসব গণদ্রব্যের দাম কমানোর সুযোগ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে। যদিও বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল ও পানির মতো গণদ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ চলছে আগের পদ্ধতিতেই।

দ্রব্যমূ্ল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা দেশের সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল গত বছরের জুনে। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও একই নীতি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে নীতি সুদহার উন্নীত করা হয়েছে ১০ শতাংশে। যদিও মূল্যস্ফীতি না কমে উল্টো অক্টোবরে এসে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ ছুঁয়েছে। আর খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি উঠেছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে। অতিসংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রভাবে বেসরকারি খাত বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা চলছে দেশের তৈরি পোশাক খাতসহ সব শিল্পে।

গত দেড় দশকে দেশে পরিবহন ব্যয় বহু গুণ বেড়েছে। এক্ষেত্রে অভিযোগ ছিল বিপুল অংকের চাঁদাবাজির। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের চাঁদাবাজরা পালিয়ে গেলেও পরিবহন ভাড়া কমেনি। এখনো বহাল রয়েছে জমি, প্লট-ফ্ল্যাটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও। এখনো বহাল রয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের কর, শুল্ক ও ব্যয় কাঠামো। সব মিলিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের পর সংসদ বিলুপ্ত হলেও শেখ হাসিনার তৈরি বাজেটেই চলছে দেশের অর্থনীতি।

এ দেড় দশকে নজিরবিহীন অরাজকতা ও লুটপাটের মধ্য দিয়ে গেছে দেশের ব্যাংক খাত। নামে-বেনামে নিজ ব্যাংক থেকেই আমানতকারীদের অর্থ লোপাট করেছেন চেয়ারম্যান-পরিচালকরা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের বেসরকারি খাতের ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে। এর ফলে লুটপাট সাময়িক বন্ধ হলেও ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের আস্থা হারিয়েছে। তীব্র হয়েছে পর্ষদ ভেঙে দেয়া ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট। চাহিদা অনুযায়ী আমানত তুলতে না পেরে লাখ লাখ গ্রাহক এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো যখন অস্তিত্ব সংকটে, ঠিক তখনই দেশে কার্যরত বিদেশী ব্যাংক ও বিশেষ কিছু বেসরকারি ব্যাংকের মুনাফা আকাশচুম্বী উচ্চতায় পৌঁছেছে। আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) বড় হয়ে ওঠায় এ ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়ছে।

শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর গত ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। সে হিসাবে অন্তর্বর্তী সরকারের শততম দিন ছিল গতকাল। অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গণমানুষের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। কিন্তু প্রথম ১০০ দিনে এর কিয়দংশও পূরণ হয়নি। সাধারণ মানুষ স্বস্তি পায় এমন কোনো উদ্যোগই বাস্তবায়ন হয়নি। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়েছে, রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন, কিন্তু শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া জনবিমুখ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

গত ১০০ দিনে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) এ নির্বাহী পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের কাছে জনগণের বিপুল প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার মতো দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকার কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে অর্থব্যবস্থায় আরো বেশি দর্শনগত পরিবর্তন আনতে হবে। সাধারণ মানুষ যেন সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তের সুফল পেতে পারে, সে উদ্যোগ নিতে হবে। সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকেও সুরক্ষা দিতে হবে।

ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের নীতিতে চলছে। মুদ্রানীতিকে আরো বেশি সংকুচিত করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে অতীতে বহুবার আমরা দেখেছি, আইএমএফের দেয়া প্রেসক্রিপশন আমাদের দেশে কাজে আসেনি। এবারও সুদহার বাড়ানোর নীতি তেমন কোনো ফল দেয়নি। আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি দর্শন দরকার। এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো দর্শন চোখে পড়েনি। তবে ১০০ দিনে হয়নি বলে আমি হতাশ নই, আশা করছি, ভবিষ্যতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে।’

কয়েক বছর ধরেই মন্দাক্রান্ত সময় পার করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা ছিল সাধারণ মানুষ। ডলার সংকট, রিজার্ভের বড় ক্ষয়সহ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিপদে ছিল বাংলাদেশ। এরপরও প্রতিবারেই ঘোষিত বাজেটের আকার আগেরবারের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাজেটের আকার দ্বিগুণ-তিন গুণ হলেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আনুপাতিক হারে বরাদ্দ কমেছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয়ের বড় অংশই গেছে পেনশনে। আবার সামাজিক নিরাপত্তাভোগীদের বড় অংশই ছিল ভুয়া ও অস্তিত্ববিহীন। সড়ক ও রেলসহ বড় বড় অবকাঠামো খাতে যে ব্যয় হয়েছে, তা-ও কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ে বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ। ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। ফলে বাজেটের বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে ঋণের দায় পরিশোধে। এভাবেই চলেছে সরকারের বড় আকারের বাজেট, যার একটি বড় অংশই চুরি ও দুর্নীতির মাধ্যমে চলে গেছে সমাজের একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর কাছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার। বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। আর ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল ঘাটতি বাজেট। এ ঘাটতি মেটানোর কথা ব্যাংকসহ দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে। বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে এডিপি হিসেবে। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও গত মাসেও দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।

গত দেড় দশকে ঘোষিত বাজেটে ঋণনির্ভরতা বেশি দেখা গেছে। যদিও কোনো অর্থবছরেই বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগের ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়নের গড় হার ছিল ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থবছরের শুরুতে যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, বছর শেষে এর ১৪-১৫ শতাংশ অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। পরে এ অবাস্তবায়িত বাজেটের অংশ আরো বড় হয়েছে।

প্রতি বছরই বড় অংকের ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করায় সরকারের ঋণের বোঝা কেবলই স্ফীত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল অন্তত ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণ স্থিতি মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা ছিল। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার জনবিমুখ এ বাজেটের সংস্কার ও পরিবর্তন করবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে অর্থবছরের বাকি মেয়াদের জন্য একটি জনমুখী বাজেট ঘোষণারও সুযোগ ছিল। প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার জনমুখী পদক্ষেপ নেবে, আর নতুন পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি কমবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সরকারের ব্যয় বাড়বে। জনগণের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা কমবে। বিদ্যুৎ-পানিসহ যাতায়াত ব্যবস্থা আরো সাশ্রয়ী হবে। কিন্তু সরকারের প্রথম ১০০ দিনে এর কোনোটিই দেখা যায়নি। উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ১০ শতাংশে উন্নীত করায় দেশের বেসরকারি খাত ঋণের খরায় ভুগছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় আরো বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে এসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির হার নেমেছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

অন্তর্বর্তী সরকার ‘সংকুচিত মুদ্রানীতির বিপরীতে সম্প্রসারিত রাজস্ব নীতিতে’ চলছে বলে মনে করেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান পদে থাকা এ শিল্প উদ্যোক্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সংকুচিত মুদ্রানীতির মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে নতুন ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। দেশের কোনো না কোনো জায়গায় প্রতিদিন শ্রমিক অসন্তোষ হচ্ছে। অথচ নির্দলীয় সরকারের জন্য এগুলোর নিয়ন্ত্রণ খুবই সহজ ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম ১০০ দিনে কোনো দৃষ্টান্তই স্থাপন করতে পারেনি।’

আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘সংকুচিত মুদ্রানীতির কারণে দেশের বেসরকারি খাত আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পের কাঁচামাল ও খাদ্যপণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এর প্রভাবে অনেক কারখানায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে, কোনোটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সরবরাহ ঘাটতির কারণে জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়বে। এতে দেশের মূল্যস্ফীতিও আরো উসকে উঠবে। দীর্ঘমেয়াদে দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিও ক্ষতির মুখে পড়বে।’

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত দুই বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করেছে। নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে বেড়েছে ব্যাংক ঋণের সুদহারও। সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের সীমা তুলে নেয়ার পর এখন ব্যাংক ঋণের সুদহার উঠেছে ১৬-১৭ শতাংশে। ঋণের সুদহার বাড়ালেও দেশের বিদেশী ও বেসরকারি খাতের কিছু ব্যাংক আমানতের সুদহার খুব বেশি বাড়ায়নি। এতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকা ওই ব্যাংকগুলোর স্প্রেড স্ফীত হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে বিদেশী ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের স্প্রেড ছিল ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এত বেশি স্প্রেডের কারণে ব্যাংকটির মুনাফা রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। কেবল ২০২৩ সালেই বহুজাতিক এ ব্যাংকটির নিট মুনাফা ছিল ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে এর আগে কোনো ব্যাংকই এ পরিমাণ নিট মুনাফা করতে পারেনি। দেশের অর্ধেকের বেশি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক দুর্বল হয়ে যাওয়ায় চলতি বছর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মুনাফা আরো বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মতোই উচ্চ মুনাফা করছে বহুজাতিক হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি)। ২০২৩ সালে এ ব্যাংকটির নিট মুনাফা ছিল ৯৯৯ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির স্প্রেড ছিল ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। অতিরিক্ত তারল্য থাকা দেশের কিছু বেসরকারি ব্যাংকও রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা পাচ্ছে। বিতর্কের মুখে পড়া ব্যাংকগুলো থেকে বের হয়ে যাওয়া আমানত অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির ব্যাংকগুলোয় যাচ্ছে। স্বল্প সুদে সংগৃহীত আমানত প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি সুদে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকেও ১২-১৩ শতাংশ সুদে অর্থ ধার দেয়া হচ্ছে।

ব্যাংক খাতের বিরাজমান অস্থিরতার কারণে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ক্ষতির মুখে পড়ছেন বলে জানান নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মাফিয়াতন্ত্র ও বিশৃঙ্খলার এখনো অবসান ঘটেনি। আবার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও সরকার এখনো পুরোপুরি সফল হয়নি। ব্যাংক খাত সংস্কারে নতুন গভর্নর বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সেসব উদ্যোগের ফলাফল এখনো পুরোপুরি দৃশ্যমান নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে হলে স্থিতিশীল ব্যাংক খাত দরকার। তবে ব্যবসায়ীদের জন্য বর্তমানে ভিন্ন ধরনের উপসর্গ সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতি কিংবা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয়, এমন ব্যবসায়ীদেরও মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। মামলার ভয় দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি চলছে। এ ধরনের অপতৎপরতার দ্রুত অবসান চাই। অন্তর্বর্তী সরকারে অনেক সৎ ও যোগ্য মানুষ আছেন। আমরা মনে করি, তাদের হাত ধরে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একটি ভালো পরিবেশ পাব।’

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের ঘোষিত বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর ২ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার স্থিতিশীল করা। যদিও কর ও শুল্কছাড়ের ঘোষণায় পণ্যের দাম কমেনি। দাম আরো বেড়ে যাওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে চাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের ওপর শুল্ক ছাড় বা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে শুল্ক প্রত্যাহারের সুফল থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন।

১৫ শতাংশ কর দিয়ে চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধান রেখেছিল শেখ হাসিনার সরকার। তবে গত ২ সেপ্টেম্বর এনবিআর থেকে জারীকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সিকিউরিটিজ, নগদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট, সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিটের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু বাজেটের সময় ঘোষিত আবাসন খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নির্ধারিত পরিমাণে কর পরিশোধের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ (কালো টাকা) প্রদর্শিত (সাদা) করা সংক্রান্ত বিধানটি বহাল রাখা হয়েছে। এতে এলাকাভেদে স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমিতে প্রতি বর্গমিটারের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শিত করার সুযোগ রয়ে গেছে এখনো।

প্রত্যাশা অনেক বেশি হওয়ায় প্রাপ্তি কম দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এ কারণে প্রথম ১০০ দিনের প্রাপ্তি কম দেখা যাচ্ছে। সরকার এরই মধ্যে বাজেটে ঘোষিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছে। এক্ষেত্রে কেবল অত্যবশ্যকীয় প্রকল্পই বাস্তবায়ন হবে। এনবিআরের পক্ষ থেকে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বাজেটে ঘোষিত কালো টাকা সাদা করার বিধান সীমিতভাবে বাতিল হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের দায়মুক্তির আইন স্থগিত করা হয়েছে। সরকারের এসব সিদ্ধান্তের সুফল জনগণ পাবে। তবে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সরকারের পক্ষে আরো জনবান্ধব পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ ছিল।’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে যাবে, এমনটিও দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় নিম্ন ও নিন্মমধ্যবিত্ত শ্রেণীকে স্বস্তি দিতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা আরো বিস্তৃত করা দরকার। সুলভ মূ্ল্যে পণ্য বিক্রির পরিসর আরো বাড়ানো দরকার।’