পুরনো চাঁদাবাজরা পালিয়ে গেলেও নতুন চাঁদাবাজের জন্ম হয়েছে – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 6 December 2024

নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে

শ্রীলংকায় -২.১০ ও পাকিস্তানে ৪.৯০ থাকলেও বাংলাদেশে ১১.৩৮%

ছবি : বণিক বার্তা

গণবিক্ষোভের মুখে দুই বছর আগে শ্রীলংকায় গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের পতন হয়। ওই সময় অর্থনৈতিকভাবে নজিরবিহীন দেউলিয়াত্বের মুখোমুখি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটি।

গণবিক্ষোভের মুখে দুই বছর আগে শ্রীলংকায় গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের পতন হয়। ওই সময় অর্থনৈতিকভাবে নজিরবিহীন দেউলিয়াত্বের মুখোমুখি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটি। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতির হার ঠেকেছিল প্রায় ৭০ শতাংশে। ডলার সংকটের কারণে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ঋণাত্মক পর্যায়ে আছে তিন মাস ধরে। গত সেপ্টেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নয়, মূল্যসংকোচনের ধারায় রয়েছে দেশটি। অর্থাৎ শ্রীলংকার বাজারে পণ্যের দাম না বেড়ে উল্টো কমছে। সর্বশেষ নভেম্বরে এসে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ১০ শতাংশ (মাইনাস ২.১০%)।

কয়েক বছর ধরে চরম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা না ফিরলেও চলতি বছরে এসে অর্থনৈতিকভাবে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশটি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় সাফল্যের দেখা পেয়েছে পাকিস্তানও। নভেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত বছরের এপ্রিলে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল।

শ্রীলংকা ও পাকিস্তান সফল হলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, নভেম্বরে দেশের মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে। অক্টোবরে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত মাসে তা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশে। বিবিএসের এ তথ্য আমলে নিলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চে।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে পালিয়ে যান টানা দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও। গণ-অভ্যুত্থানের পর সবার প্রত্যাশা ছিল দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। কমবে জিনিসপত্রের দামও। যদিও জনগণের সে প্রত্যাশা পূরণের কোনো লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। স্বীকৃত চাঁদাবাজরা পালিয়ে গেলেও পণ্যের দাম কমেনি। উল্টো অস্থিতিশীল বাজারে পণ্যের দাম আরো বেড়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির হারও আরো উসকে উঠেছে।

যদিও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে গত দুই অর্থবছর সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি প্রণয়ন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজারে অর্থের প্রবাহ কমাতে নীতি সুদহার (রেপো রেট) ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদহারও সর্বোচ্চ ৯ থেকে বেড়ে এখন ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার যে লক্ষ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারণ করেছিল, সেটি কাজে আসেনি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মূলে রয়েছে সরবরাহ ঘাটতি ও বাজার অব্যবস্থাপনা। চাহিদা নিয়ন্ত্রণ বা শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে এ মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। জিনিসপত্রের দাম কমাতে উৎপাদন ও আমদানি বাড়ানো দরকার। অন্যথায় আগামী দুই-তিন মাসে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ‘বিরাজমান মূল্যস্ফীতি সরবরাহের ঘাটতি থেকে উদ্ভূত। এ কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে দ্রুত স্বাভাবিক হয়, সে উদ্যোগ নিতে হবে। চাহিদা নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছে। এখন আর নতুন করে সুদহার বাড়ানো যাবে না। জনগণকে স্বস্তি দিতে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহার কিংবা কমিয়েছে। কিন্তু এর সুফলও বাজারে দেখা মিলছে না।’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘পুরনো চাঁদাবাজরা পালিয়ে গেলেও নতুন চাঁদাবাজের জন্ম হয়েছে। সরকার এক্ষেত্রে কঠোর হতে পারেনি। বাজারের সিন্ডিকেটও এখনো ভাঙা যায়নি। এগুলো ঠিক না হলে বাজারে শৃঙ্খলা ফেরানো খুবই কঠিন। সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি দ্রুত আমদানি বাড়িয়ে বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় রোজার মাসকে কেন্দ্র করে পণ্যবাজার আরো বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।’

প্রায় তিন বছর ধরেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এর মধ্যে গত দুই অর্থবছরজুড়েই দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি। বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস তথা জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ওই মাসে মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে আসে বলে দাবি করে বিবিএস। এরপর সেপ্টেম্বরে আরো কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ দেখানো হয়। তবে অক্টোবর ও নভেম্বরে এ হার আবারো ঊর্ধ্বমুখী হয়। অক্টোবরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার দেখানো হয় ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। সর্বশেষ নভেম্বরের তথ্য গতকাল প্রকাশ করে বিবিএস। সংস্থাটির দাবি, গত মাসে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে ঠেকেছে।

বিবিএস জানায়, নভেম্বরে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এছাড়া খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আগের মাস তথা অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত বছরের অর্থাৎ ২০২৩ সালের নভেম্বরে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ ও ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।

নভেম্বরে দেশের গ্রামাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, অক্টোবরে যা ছিল ১১ দশমিক ২৬ ভাগ। গত বছরের একই সময়ে অর্থাৎ নভেম্বরে দেশের গ্রামাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। নভেম্বরে গ্রামাঞ্চলের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৪১ ও ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। চলতি বছরের অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৭৫ ও ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং গত বছরের নভেম্বরে যা ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮৬ ও ৮ শতাংশ।

বিবিএস বলছে, নভেম্বরে শহরাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ; অক্টোবরে যা ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০২৩ সালের নভেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। নভেম্বরে শহরাঞ্চলের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ১৪ দশমিক ৬৩ ও ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০২৪ সালের অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৫৩ ও ৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের নভেম্বরে যা ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৫৮ ও ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। সারা দেশের ৬৪টি জেলার ১৫৪টি হাটবাজার থেকে নির্ধারিত সময়ে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ ভোক্তা মূল্য সূচক প্রণয়ন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের বিরাজমান এ মূল্যস্ফীতি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। এ অঞ্চলের উল্লেখ করার মতো অর্থনীতির দেশগুলো হলো ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটান। এ সাতটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি শ্রীলংকায়। সেপ্টেম্বর থেকে টানা তিন মাস দেশটির গড় মূল্যস্ফীতির হার ঋণাত্মক। অর্থাৎ এ সময়ে শ্রীলংকায় পণ্যের দাম না বেড়ে উল্টো কমে গেছে। সর্বশেষ নভেম্বরে দ্বীপ দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ১ শতাংশ। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ১ দশমিক ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি রয়েছে মালদ্বীপে। ভুটানে ১ দশমিক ৩৫, নেপালে ৪ দশমিক ৮২, পাকিস্তানে ৪ দশমিক ৯০ ও ভারতে ৬ দশমিক ২১ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে।

সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি কমার কোনো আলামত দৃশ্যমান নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এ নির্বাহী পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু ডিমান্ড সাইড (চাহিদা) নিয়ন্ত্রণ করে কাজ হবে না। এক্ষেত্রে সাফল্য পেতে হলে সাপ্লাই সাইড (সরবরাহ ব্যবস্থা) ঠিক করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করার কোনো লক্ষণীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে দেখিনি। ভোক্তা অধিকার দিয়ে বাজারে অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা ঠিক করা যাবে না। এজন্য সরকারকে সব পণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। আমদানি বাড়িয়ে বাজারে পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।’

মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘কিছু নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সরকার শুল্ক ছাড় দিয়েছে। কিন্তু বাজারে সৃষ্ট গর্তে ছাড় দেয়া শুল্ক পড়ে যাচ্ছে। শুল্ক ছাড়ের কোনো সুফল জনগণ পাচ্ছে না। এজন্য আগে গর্ত বন্ধ করতে হবে। সত্যিকার অর্থেই বাজার কারা ম্যানিপুলেট করছে, সেটি খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায় বাজার ব্যবস্থায় সরকারের সাফল্য অধরাই থেকে যাবে।’

সরবরাহে ঘাটতির কারণেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমানও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে করণীয় সম্ভাব্য সবকিছুই এরই মধ্যে করা হয়েছে। এখন আর সুদহার বৃদ্ধির সুযোগ নেই। আমি মনে করি, বাজারে চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহ কম। এ কারণে পণ্যের দাম কমছে না। এটি থেকে উত্তরণের জন্য সরবরাহ বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ দরকার।’