বড় বাজেটের প্রয়োজন নেই, দরকার বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 19 January 2025

অর্থের সংস্থান না থাকলেও বড় বাজেটের পথে হাঁটছে অন্তর্বর্তী সরকার

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কাছ থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে।

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কাছ থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আগামী অর্থবছরের জন্য ৮ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আকার কমানো হলেও আসন্ন বাজেটের ব্যাপ্তি ৮ লাখ কোটি টাকার নিচে নামবে না বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এর আগে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য মোট ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার।

বিগত সরকারের আমলে গোষ্ঠীতন্ত্রের স্বার্থরক্ষা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে প্রতি বছরই আকার বাড়ানো হয়েছে বাজেটের। যদিও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হয়নি কখনই। ফলে বাজেটের সঙ্গে ঘাটতি ও তা পূরণে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের আকারও বড় হয়েছে নিয়মিতভাবে। গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আত্মঘাতী এ বাজেট প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা হবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের জন্য আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া বাজেটে কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আনেনি অন্তর্বর্তী সরকার। বরং বিগত সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান ছাড়াই আরো বড় আকারের বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এর আগে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ঘোষিত বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে ৬ লাখ ২ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। এর ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্যও ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট রেখে গেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৫১ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। দেশী-বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণের কথা রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাস্তবায়নের সক্ষমতা না থাকলেও অতীতে বরাবরই সরকারের পক্ষ থেকে বিশাল অংকের বাজেট দেয়া হয়েছে। যদিও অর্থবছর শেষে কখনই পুরো বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বরাবরই বাজেটের বড় একটি অংশ বাস্তবায়ন হয়েছে অর্থবছরের শেষ মাসে। এতে অর্থ অপচয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাজেট বাস্তবায়নের গুণগতমান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বারবার।

চলতি অর্থবছরের বাজেট কার্যকর হয় গত ১ জুলাই। এর ৩৫ দিনের মাথায় পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এর পর সময় পেরিয়েছে পাঁচ মাসের কিছু বেশি। যদিও এখনো বিগত সরকারের রেখে যাওয়া বাজেটে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর সংশোধিত বাজেটে ঘোষিতের তুলনায় যতটা কমিয়ে আনা হয়, এবার সংশোধনের মাধ্যমে তা ছোট করার মাত্রা হবে আরো কম।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত সরকারের দিক থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা ছাড়া যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছিল, সেগুলোকে যাচাই-বাছাই করে কাটছাঁট করা হবে, এমন বলা হয়েছিল। তবে সেটি কতখানি কাটছাঁট করা হয়েছে, তা আমরা এখনো দেখিনি। তারপরও সরকারের কিছু নির্দিষ্ট খরচ রয়েছে; যেমন পরিচালন ব্যয় বা বিভিন্ন খাতে ব্যয়; সেগুলো তো কমানোর কোনো সুযোগ নেই। তবে আমার মতে, আগামী অর্থবছরের বাজেট অনেক বড় করার প্রয়োজন নেই। আবার ঘাটতিটাও কিন্তু কম রাখতে হবে। তাহলে মূল্যস্ফীতির চাপ কম থাকবে। এক্ষেত্রে ভারসাম্য করে করতে হবে। না হলে অর্থনীতি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেহেতু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, সেহেতু সরকারের আর্থিক নীতিও এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয়ের পরিস্থিতিও ভালো নয়। বিদেশী সহায়তা সেভাবে আসছে না। তাহলে বাজেটের অর্থ কোথা থেকে আসবে? এক্ষেত্রে বাস্তবায়নযোগ্য ও প্রায়োগিক একটি বাজেট দরকার।’

বাজেট প্রণয়নের অংশ হিসেবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রায় ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি), যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। এছাড়া পরবর্তী দুই অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের প্রক্ষেপণও করা হয়েছে। এতে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের প্রক্ষেপিত লক্ষ্যমাত্রা ৬ লাখ ৪৯ হাজার কোটি ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য তা ৭ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী দুই অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। চলতি মাসের শুরুতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণসংক্রান্ত বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটির (বিএমসি) সভায় এ প্রাক্কলন ও প্রক্ষেপণ চূড়ান্ত করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। প্রস্তাবিত রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করতে বিএমসির পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হবে ২২ জানুয়ারি।

চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে ৪ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আহরণ হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এ পাঁচ মাসে রাজস্ব আহরণ কমেছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত নভেম্বরে ৩৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ২৫ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনবিআরের ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আদায় হয়েছিল ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। ফলে মোট ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকায় বা ৭ শতাংশের কাছাকাছিতে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ে রাজস্ব আহরণের কাজগুলো করে থাকে কর অঞ্চল, ভ্যাট কমিশনারেট ও কাস্টম হাউজগুলো। এজন্য এসব দপ্তরের প্রতিটিকে রাজস্ব আহরণের জন্য আলাদা লক্ষ্যমাত্রা দেয়া। আগামী অর্থবছরেরও প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রায় প্রত্যেকটি কর অঞ্চল, ভ্যাট কমিশনারেট ও কাস্টম হাউজগুলোর জন্য আলাদাভাবে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। যদিও এসব অঞ্চল, কমিশনারেট ও কাস্টম হাউজের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার বিষয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে তাদের কোনো মত নেয়া হয় না। আগেও কখনো নেয়া হয়নি। রাজস্ব আহরণের জন্য তাদের ওপর শুধু লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেয়া হয়।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয় লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়। সেখানে যারা এ ধরনের কাজ করেন, তারা টেকনিক্যাল লোক না। যদিও তাদের চাপিয়ে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা আবার এনবিআরের ওপরে চাপিয়ে দেয় আইআরডি। এনবিআর সেটি কর অঞ্চলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়। এভাবে এখনো আগের মতোই চলছে। নতুন কিছু নেই।’

রাজস্ব আহরণে প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রাটি চূড়ান্ত নয় বলে জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটি চূড়ান্ত নয়। অবশ্যই আমরা বাস্তবমুখী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব।’

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গতকাল ‘শ্বেতপত্র এবং অতঃপর: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক এক সিম্পোজিয়ামে আগামী অর্থবছরের জন্য ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট হতে পারে বলে ধারণা দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও বাজেট ঘাটতি কত হতে পারে সেটি অনুমান করে আমি বাজেটের আকার সম্পর্কে ধারণা দিয়েছি। এক্ষেত্রে রাজস্ব আয় ৫ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা এবং বাজেট ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে উদারভাবে হিসাব করলে আগামী অর্থবছরের বাজেট ৮ লাখ কোটি টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। তবে যদি সংরক্ষণমূলক দৃষ্টিতে হিসাব করা হয় তাহলে বাজেট ৭ থেকে সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকা হওয়া উচিত। বর্তমানে অর্থনীতি ও রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে থাকলে আমাদের পক্ষে ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে রেমিট্যান্সের যে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে, সেটি থাকবে না। রফতানি পুনরুদ্ধারের যে ধারা, সেটি টিকবে কিনা সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ বিশ্ব পরিস্থিতি অনিশ্চিত। তবে আগামী অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে যদিও নিও-নরমাল পরিস্থিতি চলে আসে এবং যেসব সংস্কারের রূপরেখা দেয়া হয়েছে, সেগুলোর কিছু যদি বাস্তবায়ন হয়; তাহলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে এবং বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সেটিকে ধরে নিয়েই আমরা এ পূর্বাভাস দিয়েছি।’

রাজস্ব আহরণ না বাড়লেও প্রতিনিয়ত বাড়ছে সরকারের ব্যয়। এতে বাড়ছে সরকারের ঋণনির্ভরতাও। বর্তমানে সরকারের রাজস্ব আয়ের সিংহভাগই চলে যাচ্ছে ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধে। এক সময় সরকারের পরিচালন ব্যয়ের ৩০ শতাংশেরও কম অর্থ ব্যয় হতো ঋণের সুদ পরিশোধে। কিন্তু চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পরিচালন ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি অর্থ এ খাতে ব্যয় করতে হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণ অনুসারে, চলতি অর্থবছরে সরকারকে সবচেয়ে বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এমনকি চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ রাজস্ব আয়কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে আইএমএফের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সংস্থাটি আগের দুই অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল, সেটি পূরণ করতে পারেনি সরকার। এ অবস্থায় চলমান ঋণ কর্মসূচির অধীনে প্রতি বছরই বাংলাদেশের জন্য রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াচ্ছে আইএমএফ। চলতি অর্থবছরের জন্য সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে সংস্থাটি। যদিও দেশের বিদ্যমান প্রতিকূল অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক পরিস্থিতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থনীতি সম্পর্কে সচেতন মানুষ বাজেটের আকার ও রাজস্ব আয়ের সংখ্যাগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন যে অবাস্তব কল্পকাহিনী রচনা করা হচ্ছে। এতে আগেকার সরকারের চিন্তাধারার সঙ্গে এ সরকারের পার্থক্য করার সংগত কারণ থাকে না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার যেসব বিষয়ে বর্তমান সরকারকে গুরুত্ব দেয়া উচিত, সেখানে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এত বড় একটি গণ-অভ্যুত্থানের পর অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসা উচিত ছিল তার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আগের মতোই গতানুগতিক ধারায় চলছে। বাজেটের আকার আমাদের সম্পদের প্রাপ্যতার সঙ্গে ভারসাম্য রেখে নির্ধারণ করা উচিত। সম্প্রতি রাজস্ব আয় বাড়াতে মূসক ও শুল্ক আরোপের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেটি ছিল একটি অবাস্তব চিন্তা। আবার এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ করার কারণে কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাট কমাতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে একটি অপসংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। যাদের মাথা থেকে এ ধরনের চিন্তা এসেছে, তারা সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে স্থিতিশীল করার পরিবর্তে অস্থিতিশীল করতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার একটি বড় দিক হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা।’

তিনি আরো বলেন, ‘আগের সরকারের সময় বিশাল আকারের বিলাসী বাজেট করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে এত বড় বাজেট প্রণয়নের সংগতি বা সক্ষমতা আমাদের নেই। ফলে অপচয়-দুর্নীতি হয়েছে। উন্নয়ন বাজেটের কত অংশ সত্যিকার অর্থে কাজে লেগেছে আর কতটা অপচয় হয়েছে, সেটি বের করলে দেখা যাবে যে সিংহভাগই অপচয় হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হচ্ছে একটি সাময়িক সরকার। একটি বাজেট বাস্তবায়ন করার জন্য যে ধরনের নেটওয়ার্ক ও সক্ষমতা প্রয়োজন, সেটি এ সরকারের নেই। বিভিন্ন কারণে আগের সরকারের তুলনায় বর্তমানে এ সক্ষমতা ক্রমেই ক্ষয় হয়েছে। ফলে ক্রমাবনতিশীল এ অবস্থায় এ রকম বিশাল বাজেট প্রণয়ন করা অবাস্তব কাজ হবে। আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতায় যে অবনতি হয়েছে, সেগুলোর উন্নয়নে সরকারের জোর দেয়া উচিত। আগের সরকারের সময়ে বড় বাজেট দেয়ার মাধ্যমে বাহ্বা নেয়ার যে প্রবণতা ছিল, সে ধরনের মনোভাব যদি বর্তমান সরকারের মধ্যেও থাকে; তা দুঃখজনক। গতবারের বাজেট বাস্তবায়নের সময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেমন ছিল, বর্তমানে তা আরো খারাপ হয়েছে। গত জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসেনি। এ পরিস্থিতিতে এত বড় বাজেট বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’