Originally posted in প্রতিদিনের বাংলাদেশ on 22 January 2025
উন্নয়ন প্রকল্প
বরাদ্দে তোড়জোড়, কাজে ঠনঠন
দেশের দুর্দশাগ্রস্ত খাতগুলোর একটি হলো স্বাস্থ্য। যেখানে প্রকট আকার ধারণ করেছে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়লেও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের হার খুবই কম। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রকল্পগুলোর গড় বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৫.০৬ শতাংশ। বিশেষত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়ন হতাশাজনকভাবে নেমে এসেছে ০.১৪ শতাংশে। এই দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিবছর ৮ লাখ রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। চিকিৎসা খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা এতটাই প্রকট যে, সরকারি সেবা নিতে গিয়ে ৪৮.৭ শতাংশ পরিবার দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জনগণকে নিজেই বহন করতে হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর পরিকল্পনা ছাড়া এ খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মত বিশ্লেষকদের।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারের কাজ ডাক্তার দিয়ে করালে তো এমন হবেই। নির্মাণ বিষয়ে ডাক্তারদের ন্যূনতম জ্ঞান না থাকলেও তাদের দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ডাক্তারদের প্রকল্প পরিচালক করায় তারা যথাযথভাবে কাজের তদারকি করতে পারছেন না। এ ছাড়া তাদের তো চেম্বার ও হাসপাতালেও সময় দিতে হয়। এজন্য হাসপাতাল নির্মাণ হলেও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারদেরই নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন, তবেই কাজ দ্রুত শেষ হবে।’
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর (বাজেট) বাস্তবায়নের হার সবসময়ই সবচেয়ে খারাপ। কেন তারা বছরের পর বছর খরচ করতে পারছে না, তা সরকারের পর্যালোচনা করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে জুলাই-আগস্টের অস্থিরতা, প্রকল্পে ব্যয় সংকোচন, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া এবং অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কম খরচ হওয়া। এটার একটা প্রবণতা থাকে।’
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১৬ হাজার ৮৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এডিপির বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক নির্মাণ, সিটিস্ক্যান, এমআরআই মেশিনসহ সব ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য। অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্যই এই বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এডিপিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মোট প্রকল্পের সংখ্যা ২৮টি। এসব প্রকল্পের বিপরীতে মোট বরাদ্দ রয়েছে ১৬ হাজার ৮৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫৫৬ কোটি ৪ লাখ টাকা; যা শতাংশের হিসাবে ৫.০৬। অর্থাৎ প্রতি মাসে এক শতাংশেরও কম কাজ হয়েছে। বাকি ছয় মাসে প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ করতে হবে; যা প্রায় অসম্ভব মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এডিপিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি আলাদা বিভাগের অধীনে মোট ২৮টি প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ১৫টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ রয়েছে ১১ হাজার ১৫৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। অর্থবছরের ছয় মাসে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে ৪.৯২ শতাংশ; যা আর্থিক হিসাবে ৫৪৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
অপরদিকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ১৩টি প্রকল্পের বিপরীতে চলতি অর্থবছর বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। অর্থবছরের ছয় মাসে ব্যয় হয়েছে ৭ কোটি ৬ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন হার ০.১৪ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নের হার কম হওয়ার পেছনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা কম থাকা একটি সাধারণ কারণ।’ সঠিক প্রকল্প নির্বাচনের অভাব দুর্বল বাস্তবায়নের জন্য দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।’
প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারেÑ এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, দেশের উন্নয়নে আমাদের সামগ্রিক চিন্তাভাবনা করা দরকার। যেহেতু সরকার বর্তমানে অর্থ সংকটে ভুগছে, সেহেতু বিকল্প ভাবতে হবে। প্রকল্পে কাটছাঁটের পাশাপাশি খরচেও সাশ্রয়ী হতে হবে। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি আনতে হলে রাজস্ব আদায়ে জোর দিতে হবে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতে এডিপির বাস্তবায়ন কম হওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এক ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। দ্রুতই এই বিশৃঙ্খলার সমাধান করা হবে।
তিনি বলেন, জেলা-উপজেলাগুলোয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অনেক প্রযুক্তি রয়েছে। যেগুলো ব্যবহার হচ্ছে না। সুতরাং এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে দক্ষতা বাড়াতে হবে বলে মত দেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫ হাজার ৪৬১টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮১০টি ঢাকা বিভাগে অবস্থিত। পাশাপাশি ৩৬টি স্পেশালাইজড হাসপাতালের মধ্যে ১৯টি ঢাকায় অবস্থিত হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঢাকার ওপর চাপ বাড়ছে।
বিদেশে চিকিৎসা নেন ৮ লাখ রোগী
প্রতিবছর ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ ১৯টিরও বেশি দেশে ৮ লাখের বেশি রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। এর মধ্যে ১৭ শতাংশ হৃদরোগ, ১৪.৫ শতাংশ কিডনি, ১১.৫ শতাংশ অর্থপেডিক সার্জারি, ১১ শতাংশ লিভার ও ক্যানসার, ৯ শতাংশ নিউরোলজি, ৬ শতাংশ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও ইউরোলজি এবং ৪ শতাংশ গাইনোকলজি ও জেনারেল সার্জারির জন্য বিদেশমুখী। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) গবেষণায় এসব তথ্য উঠে আসে।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া, ভুল রোগ নির্ণয় এবং অব্যবস্থাপনার কারণে আস্থা হারিয়ে রোগীরা বিদেশে যাচ্ছেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশে চিকিৎসা খাতে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন।
চিকিৎসা ব্যয় বেশি বাংলাদেশে
দেশে স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ নিজেকেই বহন করতে হয়, যা শুধু আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় স্বাস্থ্য খাতের সরকারি বরাদ্দ অন্য দেশের তুলনায় কম, মাত্র ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ‘ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ : প্রসপেক্ট অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অব হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন ইম্প্রুভমেন্ট’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে এ তথ্য উঠে আসে।
গবেষণায় জানানো হয়, ভারতে চিকিৎসা ব্যয় মানুষের পকেট থেকে যায় ৪৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, ভুটানে ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ, মালদ্বীপে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ, নেপালে ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৪৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। তবে আফগানিস্তানে এ ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ৭৭ দশমিক ২০ শতাংশ। বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয়ে সবচেয়ে বেশি যায় ওষুধ কিনতে ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়
সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতে বলা হয়েছে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে ৪৮.৭ শতাংশ পরিবার দুর্নীতির শিকার হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় এ হার ৪৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৫১ শতাংশ। সেবা নেওয়ার সময় গড়ে ৬৮০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সেবা নিয়েছে ৩২.২ শতাংশ পরিবার, তবে দুর্নীতির হার জেলা সদর হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি, ৫২.৪ শতাংশ। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুষ দেওয়ার ঘটনা ১২ শতাংশ ছিল। জরিপে উঠে এসেছে, ট্রলি/হুইলচেয়ার সেবা নিতে গিয়ে ৫৬.৫ শতাংশ পরিবার দুর্নীতির সম্মুখীন হয়েছে এবং খাদ্য পরিষেবায় দুর্নীতির হার ৬৬.৪ শতাংশ ছিল।
সন্তান জন্মদান বা সি-সেকশনে গড়ে ২ হাজার ২৫৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের ট্রলি/হুইলচেয়ারের ঘুষ গড়ে ১৪১ টাকা এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের ঘুষ গড়ে ১৭ টাকা ছিল।
এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালগুলোর বাজেট বরাদ্দের সময় সেবা গুণমান বা রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়গুলো যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয় না, যার ফলে সেবা ব্যবস্থায় অদক্ষতা এবং বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।