Originally posted in The Business Standard on 29 January 2025
উৎপাদন খাত স্থবির, সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি; বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে অসম প্রবণতা
গত এক দশকে উৎপাদন খাতের স্থবিরতা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও প্রভাব ফেলেছে। ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর কর্মসংস্থান দ্বিগুণ হলেও, পরবর্তী দশকে তা মাত্র ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত এক দশকে বাংলাদেশে উৎপাদন খাত স্থবির হয়ে পড়েছে, বিপরীতে সেবা খাতের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ঘটেছে—যা উন্নত অর্থনীতির প্রচলিত প্রবণতা থেকে ভিন্ন।
সাধারণত উন্নত দেশগুলোতে শক্তিশালী শিল্পায়নের পর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সেবা-নির্ভর হয়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন কাঠামোগত দুর্বলতা ও নীতিগত অসঙ্গতির প্রতিফলন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের অভাব এবং আমদানির ওপর বাড়তি নির্ভরতা এর অন্যতম কারণ।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, প্রায়ই ‘প্রিম্যাচিউর ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ বলে পরিচিত এ প্রবণতা দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। কারণ, উৎপাদন খাত ঐতিহ্যগতভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকা শক্তি। সেবা খাত সম্প্রসারিত হলেও, এটি শিল্প খাতের পতনের ফলে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি।
বুধবার (২৯ জানুয়ারি) প্রকাশিত হতে যাওয়া সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ১১.৮৭ মিলিয়ন অর্থনৈতিক ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে ৮.৭৭ শতাংশ উৎপাদন এবং ৯১.২৩ শতাংশ সেবা খাতে যুক্ত। তুলনামূলকভাবে, ২০১৩ সালে উৎপাদন খাতের অংশ ছিল ১১.৫৪ শতাংশ, এবং ২০০৩ সালে ছিল ১২.১৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দেশে উৎপাদন ইউনিটের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হলেও, পরবর্তী এক দশকে এ বৃদ্ধির হার কমে মাত্র ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৩ সালে দেশে চার লাখ ৫০ হাজার ৩৪৮টি উৎপাদন ইউনিট ছিল, যা ২০১৩ সালে বেড়ে নয় লাখ দুই হাজার ৫৮৩টিতে পৌঁছায়। তবে ২০২৪ সাল নাগাদ এ সংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ১০ লাখ ৪০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
স্থায়িত্বের হুমকি
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ টিবিএসকে বলেন, “সেবা খাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ও উৎপাদন খাতের স্থবিরতা মিশ্র সংকেত দিচ্ছে। খুচরা ব্যবসা ও উৎপাদিত পণ্যের বিক্রির ওপর নির্ভরশীল সেবা খাত বার্ষিক শ্রমবাজারে প্রবেশ করা ২০ লাখ তরুণের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না। ফলে টেকসই কর্মসংস্থানের জন্য উৎপাদন খাতের বিকাশ অপরিহার্য।”
তিনি আরও বলেন, ভোগের ধরনে পরিবর্তন সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করলেও, এর স্থায়িত্ব নির্ভর করছে উৎপাদনের ওপর।
উৎপাদন খাত দুর্বল হলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে এবং সেবা খাতের উদ্ভাবনী সক্ষমতাও ঝুঁকির মুখে পড়বে। “শক্তিশালী উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ছাড়া সেবা খাতের সম্প্রসারণ স্থবির হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করবে,” যোগ করেন মাসরুর রিয়াজ।
গত এক দশকে উৎপাদন খাতের স্থবিরতা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও প্রভাব ফেলেছে। ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর কর্মসংস্থান দ্বিগুণ হলেও, পরবর্তী দশকে তা মাত্র ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০০৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোতে কর্মসংস্থান ছিল ১.১২ কোটি, যা ২০১৩ সালে বেড়ে ২.৪৫ কোটিতে পৌঁছায়। তবে ২০২৪ সালে এটি মাত্র ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩.০৮ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।
‘একটি উদ্বেগজনক লক্ষণ’
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়িক নেতারা উৎপাদন খাতের এ পতনকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক সংকেত হিসেবে দেখছেন। শ্রমঘন অর্থনীতিতে উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ না হওয়ায় মূল্য সংযোজন সীমিত হচ্ছে এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করছে।
উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্বল অবকাঠামো, জ্বালানি সংকট, অসামঞ্জস্যপূর্ণ রাজস্ব নীতি ও ঘন ঘন পরিবর্তিত অর্থনৈতিক নীতি।
জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানির মতো প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলো প্রথমে শক্তিশালী শিল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে উচ্চ কর্মসংস্থান ও মাথাপিছু আয় নিশ্চিত করে, এরপর সেবা খাতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান অর্জনের আগেই উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। পাশাপাশি, ব্যবসায়িক আগ্রহও ক্রমশ সেবা ও বাণিজ্য খাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
কেন উৎপাদন খাত পিছিয়ে পড়ছে?
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “বিএসসিআইসির কিছু প্লট ছাড়া দেশে উল্লেখযোগ্য শিল্প অবকাঠামোতে বিনিয়োগের অভাব দীর্ঘদিনের। জমির উচ্চমূল্য ও উন্নয়ন ব্যয় উৎপাদন বিনিয়োগকে ব্যয়বহুল করে তুলছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলেও, এখনো সেগুলো পুরোপুরি বিনিয়োগ-বান্ধব হয়ে ওঠেনি।”
তিনি আরও বলেন, গ্যাস সংযোগ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, যা উৎপাদন বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। উচ্চ ব্যয় ও পরিচালন-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের কারণে অনেক উদ্যোক্তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। ফলে ছোট ব্যবসাগুলোর উৎপাদন খাতে প্রবেশের সুযোগ সীমিত থেকে যাচ্ছে।
“শিল্প অবকাঠামো, জ্বালানি সরবরাহ ও স্থিতিশীল রাজস্ব নীতি উৎপাদন প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” বলেন জসিম উদ্দিন। “কিন্তু এগুলোর অভাবে বাংলাদেশ এখনো একটি শক্তিশালী উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি, যদিও সেটাই হওয়ার কথা ছিল।”
বিনিয়োগ-বান্ধব নীতি সংস্কারের আহ্বান
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সাধারণত দেশগুলো কৃষি থেকে শিল্পে, তারপর সেবা খাতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ শিল্প খাতকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি কৃষি থেকে সেবা খাতে চলে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগকারীরা স্থায়ী শিল্প প্রতিষ্ঠানের বদলে ক্ষুদ্র ইউনিটগুলোর দিকে ঝুঁকছেন। এর ফলে অনানুষ্ঠানিক, নিম্ন-আয় ও নিম্নমানের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তৈরি হচ্ছে, যা সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে পারছে না।
মোয়াজ্জেম বলেন, “শিল্প খাতের এ স্থবিরতা সরকারের নীতির গুরুতর ত্রুটির প্রতিফলন। আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট এবং মুদ্রানীতি আরও শিল্প-বান্ধব করতে জরুরি ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা দরকার।”
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, “উৎপাদন খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে কর ও রাজস্ব নীতিগুলো প্রতি বছর পরিবর্তিত হয়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকেন। তাই অনেকেই উৎপাদন খাতে মূলধন ঝুঁকির চেয়ে বাণিজ্য ও সেবা খাতে বিনিয়োগ করাকে বেশি নিরাপদ মনে করেন।”