বৈশ্বিক শুল্কযুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে – ড. মোয়াজ্জেম

শুল্কযুদ্ধের মূল্য দিতে হবে সব দেশকে

Originally posted in কালেরকন্ঠ on 9 March 2025

শুল্কযুদ্ধের মূল্য দিতে হবে সব দেশকে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশেষে মেক্সিকো ও কানাডার সব পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে দিলেন। জবাবে কানাডাও পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। ট্রাম্পের শুল্কের কবলে পড়েছে চীন-ভারতও। তীর তাক করা আছে ইউরোপের দিকেও। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি যে আরেকটি বাণিজ্যযুদ্ধে প্রবেশ করেছে তাতে সন্দেহ নেই।

ট্রাম্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে এই বহুমুখী শুল্কযুদ্ধের সূচনা বিশ্বকে আরেকটি মহামন্দার দিকে নিয়ে যাবে বলে সতর্ক করছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি)। প্রতিষ্ঠানটির উপসাধারণ সম্পাদক অ্যান্ড্রু উইলসন সতর্ক করে বলেন, ‘আমাদের গভীর উদ্বেগ হচ্ছে এই শুল্কযুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র যদি ফিরে না আসে, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিকে ১৯৩০ সালের মতো আরেকটি মহামন্দার মুখোমুখি হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধের ফলে শুধু বিশ্ব অর্থনীতিই মন্দায় পড়বে না, মার্কিন অর্থনীতিকেও চড়া মূল্য দিতে হবে।

ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পের এই শুল্কযুদ্ধে বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্যই শুধু হুমকি নয়, স্বয়ং আমেরিকাও বিপদে পড়বে। যার নিদর্শন এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ওয়ালস্ট্রিটের শেয়ারমূল্য কমে যাচ্ছে। ট্রাম্প গত নভেম্বরে বিজয়ী হওয়ার পর থেকে শুল্ক আতঙ্কে বাজার মূলধন এরই মধ্যে ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়ে গেছে। ফলে শুল্কযুদ্ধের বিপদ সব দেশকেই ভোগাবে।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বিশ্বজুড়ে যে বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তার বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল ৪ ফেব্রুয়ারি চীনের ওপর বর্ধিত হারে শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে। মেক্সিকো ও কানাডার ওপর শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে সেই চক্র যেন পূর্ণ হলো।

ইটের বদলে পাটকেল ছুড়তে তাঁরা যে পিছপা হবেন না, তা বুঝিয়ে দিতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানিয়ে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁদের দেশে আসা ৩০ বিলিয়ন কানাডীয় ডলারের পণ্যে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ হচ্ছে সেদিন থেকেই। বাকি যে ১২৫ বিলিয়ন বা ১২ হাজার ৫০০ কোটি কানাডীয় ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডা আমদানি করে, তার ওপরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে ২৫
মার্চ থেকে।

চুপ করে বসে নেই মেক্সিকোও। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়ে, তাদের রপ্তানির ৮০ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে। শিগগিরই ট্রাম্পের নতুন সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শিনবাম সংবাদ সম্মেলন করে জানান, সেদিন থেকেই মার্কিন পণ্যের ওপর সমহারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। তবে ট্রাম্পের প্রথম ধাক্কায়ই মেক্সিকোর মুদ্রা পেসোর মান এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, কানাডা ও মেক্সিকোর তুলনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে চীনের পাল্টা ব্যবস্থায়। চীনের পণ্যেও ট্রাম্প আরোপিত শুল্ক দ্বিগুণ হয়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গত সপ্তাহে বলেছেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পাল্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা মুরগির মাংস, গরুর মাংস, ভুট্টা, সামুদ্রিক খাবারসহ একাধিক পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক কার্যকর করা হবে অবিলম্বে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও ছেড়ে কথা বলছেন না ডোনাল্ড ট্রাম্প। কয়েক দিন আগেই ২৭ দেশের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জোটকে ট্রাম্প এই বলে একহাত নিয়েছেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিতই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলার জন্য। তাদের ওপরও ২৫ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ করা হবে। সরকারি ঘোষণা হবে শিগগিরই, যার পাল্টা হিসেবে কড়া ভাষায় ট্রাম্পকে সতর্কবাণী শুনিয়েছে ইইউ। বলেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই ধরনের অন্যায্য কোনো পদক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না। পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ট্রাম্পের ঘোষণা অনুসারে, এই বাণিজ্যযুদ্ধ রোধের কফিনে সম্ভবত শেষ পেরেক পোঁতা হবে আগামী ২ এপ্রিল। কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, সেদিন থেকে গাড়ি-সেমিকন্ডাক্টর চিপ, ওষুধসহ সব ক্ষেত্রে পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হবে। অর্থাৎ যে দেশ মার্কিন পণ্যে যতটা শুল্ক আরোপ করে, সেই দেশের পণ্যে ততটাই শুল্ক আরোপ করা হবে।

সে হিসাবে ২ এপ্রিল থেকে ট্রাম্পের ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি কার্যকর হচ্ছে ভারতের ওপরও। এ বিষয়ে দেশটির অর্থনীতিবিদ অজিতাভ রায় চৌধুরী বলেন, ‘ট্রাম্প যদি ভারতের ওপর শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে এর বিরূপ প্রভাব দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে পড়বে। বর্ধিত শুল্ক দীর্ঘদিন চললে রপ্তানিভিত্তিক সংস্থার শেয়ারের দাম পড়তে পারে।’

বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ শুল্কযুদ্ধ শুরু হলো। এরই মধ্যে বিশ্বের আর্থিক বাজারে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আবার মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে পারে। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের যেমন ক্ষতি হবে, তেমনি দুর্বল হবে বিশ্ব অর্থনীতির ভিত। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশ আবারও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়তে পারে। বন্ধ হতে পারে নীতি সুদ কমানোর পথ। ধাক্কা খেতে পারে আর্থিক প্রবৃদ্ধি।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এ ধরনের নীতির ফলে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাঁর এই নীতি বাস্তবায়িত হলে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিনিয়োগ কমে যাবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বাংলাদেশ। শুল্কযুদ্ধের প্রভাব নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, বিশ্বব্যাপী একজন আরেকজনের প্রতিপক্ষ হিসেবে পণ্যের শুল্ক বৃদ্ধি করলে সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে। পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। এতে জনগণ ও ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাবে। শ্লথ হয়ে পড়বে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি। এর প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতেও মন্থর গতি চলে আসবে, যা বাংলাদেশের মতো দেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি হলে সংশ্লিষ্ট দেশের ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। তাদের আমদানি করা পণ্য ব্যবহারের সুযোগ কমে যাবে। এতে আমাদের মতো রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল দেশ তাদের কাছে পণ্য ও সেবা বিক্রি করতে পারবে না। আবার তাদের কাছ থেকে বেশি মূল্যে পণ্য আমদানি করতে গিয়ে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি ঘটবে দেশের ভেতর।’

এই গবেষক মনে করেন, স্বল্প মেয়াদে হয়তো বাংলাদেশের কিছু সুবিধা আসতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে, তা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের কৌশল নির্ধারণের দিকে নজর দেওয়া দরকার। নিজেদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ করে পণ্য বিক্রি যেন অব্যাহত থাকে, রপ্তানি বাধাগ্রস্ত না হয়, এসব বিষয়ে অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি রাখা দরকার।