কর্মসংস্থান না বাড়লে দীর্ঘ মেয়াদে শঙ্কা তৈরি হতে পারে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in কালেরকন্ঠ on 8 March 2025

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার এমন এক সময়ে দায়িত্ব নিয়েছিল যখন রপ্তানি প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমেছিল, রেমিট্যান্স আসা অর্ধেকে নেমেছিল, ডলারের রিজার্ভ নেমেছিল তলানিতে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ধস নেমেছিল, অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ব্যাংক খাতে চলছিল লুটপাট, মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট ছিল ক্রেতা, সহযোগী দেশগুলো সহায়তার হাত গুটিয়ে নিয়েছিল।

তবে সেই অবস্থা থেকে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। রপ্তানিতে সাত মাসে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, রেমিট্যান্স ইতিহাসের রেকর্ড গড়ে ১৮ বিলিয়নে নামা রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ছুঁয়েছে।

ব্যাংক খাতে লুটপাট বন্ধ হয়েছে, আস্থা ফিরেছে। অনেকটাই কমেছে মূল্যস্ফীতি, পাশে দাঁড়িয়েছে সহযোগী দেশগুলোও। তবে এখনো বাকি রয়েছে অনেক কাজ, এই সরকারের প্রতি জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি।

সরকার পরিবর্তনের পর অর্থনীতিতে বহু পরিবর্তন এসেছে। এর কিছু ইতিবাচক এবং কিছু নেতিবাচক। যেমন—আমরা রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখেছি। বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা পাচার বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। হুন্ডিচক্র দুর্বল হওয়ার ফলে অপ্রাতিষ্ঠানিক রেমিট্যান্স কমে বৈধ পথে প্রবাহ বেড়েছে।

এটার একটা প্রভাব আমরা রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধির মধ্যে দেখেছি, যার ফলে আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য (বিওপি) স্বস্তির মধ্যে রয়েছে। অনেক দিন পরে চলতি হিসাবে আমরা পজিটিভ হয়েছি। এটার সুযোগে আমদানির ওপরে যে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা রাখা হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে তুলে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে এগুলো ইতিবাচক।

আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে নামিয়ে নিয়ে আসার বিষয়ে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল তা পুরোপুরি পূরণ হয়নি।

কিছুটা কমলেও মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চ স্তরেই রয়েছে। এটা সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকঋণের সুদহার একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে নতুন কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না।

বিনিয়োগকে চাঙ্গা করা একটি চ্যালেঞ্জ। সেটা অর্থনীতিতে কিন্তু রয়েই গেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে নতুন কর্মসংস্থান না বাড়লে দীর্ঘ মেয়াদে শঙ্কা তৈরি হতে পারে। এটাও একটা চিন্তার কারণ।

বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে তেমন ইতিবাচক উন্নতি নেই। মূলধনী যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানার আমদানিতে স্থবিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ব্যাংকের উচ্চ সুদহারের কারণে বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করতে না পারায় বিডার পরিকল্পনাও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তারা কয়েকটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন চালু করতে চেয়েছিল, কিন্তু গ্যাস সংযোগ, বিদ্যুত্ সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না। সরকারের সার্বিক সক্ষমতা কম হওয়ায় আমাদের অর্থনীতিকে পুরোপুরি বিনিয়োগবান্ধব করা সম্ভব হয়নি।

ব্যাংক সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেমন—বিভিন্ন টাস্কফোর্স গঠন, বিএফআইইউ সক্রিয়করণ এবং দুদক মিলে কাজ করছে। তারা ব্যাংক লুটকারীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করা যায়নি। ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না, কারণ অর্থনীতিতে যেকোনো পদক্ষেপের সুফল পেতে কিছুটা সময় লাগে।

প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করার দিকে মনোযোগী হতে হবে। এ ছাড়া সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী করা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সক্রিয় করতে পারলে রাজস্ব আহরণ ও বাজেট ঘাটতি কমানো যাবে। বাজেট সামনে রেখে ডিজিটাইজেশন ও করনেট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আশা থাকবে। বিশেষত প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে যেসব কর ফাঁকি আছে, সেগুলো প্রতিরোধ করতে হবে।

যেহেতু আমাদের ক্রয়ক্ষমতার অবনতি হয়েছে, আমানতের বৃদ্ধির থেকে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় দ্বিগুণ, তাই সামাজিক সুরক্ষার হার বৃদ্ধি করতে হবে। খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বৃদ্ধি, ভাতা, বিভিন্ন কার্ড বাড়াতে হবে। এ জন্য যে টাকার প্রয়োজন হবে তা প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমেই আসবে। তাই প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধির মাধ্যমে সার্বিক রাজস্ব বাড়াতে হবে।

ঋণ পরিষেবার চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সুতরাং রাজস্ব আদায় না বাড়াতে পারলে ঋণ এনে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেটা কোনো অর্থনীতির জন্যই ভালো নয়। সার্বিক চাপ সরকারকে সামাল দিতে হচ্ছে। তাই সামনে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো সব কিছু করে যেতে পারবে না। তাদের দেখানো পথে পরের সরকার এসে বাকি কাজগুলো বাস্তবায়ন করবে বলে আশা থাকবে।

লেখক : সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)