Originally posted in সময়ের আলো on 5 May 2025
বিদেশেই গায়েব রেমিট্যান্স
প্রবাসীদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স গায়েব করা হতো বিদেশে। পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চেধুরী জাভেদের নেতৃত্বে একটি চক্র টাকা পাচারের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় রেমিট্যান্সকে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো তাদের মালিকানাধীন বিদেশে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের রেমিট্যান্স হাউস ও ব্যাংকের শাখা-উপশাখা কর্মকর্তাদের।
প্রবাসীরা ওইসব ব্যাংকের হাউসে রেমিট্যান্স জমা দিলেও সেটা সরিয়ে নিত চক্রটি। তার পরিবর্তে দেশে থাকা সংশ্লিষ্ট প্রবাসীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অথবা তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে দেওয়া হতো নগদ টাকা। ফলে ব্যাংকে জমা দিতে আসা রেমিট্যান্সও হুন্ডির কবলে পড়েছে বেপরোয় ওই চক্রটির কারণে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের জনশক্তি রফতানি ২ লাখ থেকে ১৩ লাখ পর্যন্ত উন্নীত হলেও প্রবাসী আয় বাড়েনি। এই চার বছরে গড়ে প্রতি বছর দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২১.৭৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আ.লীগ সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালে জনশক্তি রফতানি ১৩ লাখ থেকে কমে ১০ লাখে এলেও প্রবাসী আয় ৫.১৩ বিলয়ন বেড়ে দাঁড়ায় ২৬.৮৯ বিলিয়ন ডলারে।
জনশক্তি খাত সংশ্লিষ্ট ও ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে রেমিট্যান্সের টাকা দেশে না এনে অন্যত্র সরিয়ে নিত বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল ইসলাম ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। তাদের মতো আরও অনেক রাঘব-বোয়াল টাকা পাচারের জন্য রেমিট্যান্সের অর্থ সরাত বলেই জনশক্তি রফতানি কয়েকগুণ বাড়লেও দেশে রেমিট্যান্স কম এসেছে।
ঠিক এমনই তথ্য জানালেন এস আলম গ্রুপের কব্জায় থাকা একটি ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। জনশক্তি রফতানি কম হলেও বিগত কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স বাড়ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর টাকা পাচার বন্ধ হয়ে গেছে।
এ ছাড়া অনেক ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তন আসায় ইতিবাচক প্রভাবও পড়েছে রেমিট্যান্সে। যেমন- এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল ইসলাম বা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের অন্যতম মালিক ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ তাদের অধীনে থাকা ব্যাংকের ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়ে টাকা পাচার করতেন।
যেমন সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে তাদের অধীনে থাকা ব্যাংকের রেমিট্যান্স হাউস বা ব্যাংকের শাখা-উপশাখা আছে। এসব উপশাখা ব্যবহার করেই তারা দেশের টাকা পাচার করত। ওইসব দেশের শাখা-উপশাখার মাধ্যমে প্রবাসীরা যেসব অর্থ দেশে পাঠানোর জন্য জমা দিতেন সে অর্থ তখন ওই শাখা থেকে দেশে পাঠাত না, ওই টাকা তারা নিজেদের কাছেই রেখে দিত। পরে ওই ব্যাংকের মালিকদের নির্দেশ মতো টাকা অন্য দেশে সরানো হতো। আর দেশে থাকা ব্যাংক থেকে ওইসব প্রবাসীর অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে দিত বা তাদের আত্মীয়-স্বজনকে দিত। এসব টাকা পাচারকারীদের একটি চেইন ছিল ব্যাংকগুলোর মধ্যে। এ কারণে বিগত সরকারের সময় শ্রমিক বেশি গেলও রেমিট্যান্স কম আসত। এখন এই পথগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে শ্রমিক কম গেলেও রেমিট্যান্স বাড়ছে।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি হয়েছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন। ওই বছর দেশে রেমিট্যান্স আসে ২১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের। অথচ ২০২৩ সালে দেশ থেকে জনশক্তি রফতানি হয় ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন। এর বিপরীতে দেশে রেমিট্যান্স আসে ২১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারের। আর ২০২৪ সালে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন জনশক্তি রফতানি হলেও রেমিট্যান্স আসে ২৬ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া এর মাঝের দুই বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে জনশক্তি রফতানি হয় ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন, বিপরীতে দেশে রেমিট্যান্স আসে ২২ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালে দেশ থেকে জনশক্তি রফতানি হয় ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন, এর বিপরীতে রেমিট্যান্স আসে ২১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের।
সরকার বদলের পর পাল্টে যায় চিত্র
গত জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটলে এবং আগস্টের প্রথম সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পাল্টে যায় রেমিট্যান্স আহরণের চিত্র। এ সময় জনশক্তি রফতানি কম হলেও বাড়তে থাকে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। পলাতক হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকা শেষ মাস অর্থাৎ গত জুলাই মাসে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। পরের মাস আগস্টে দেশে রেমিট্যান্স আসে ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে আসে ২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার, অক্টোবরে ২ দশমিক ৩৯ বিয়িলন ডলার, নভেম্বরে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার, ডিসেম্বরে ২ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার, জানুয়ারিতে ২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার, ফেব্রয়ারিতে ২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া গত মার্চ মাসে আসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। আর সর্বশেষ এপ্রিল মাসে আসে ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার।
এ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে চলতি ২০২৫ সালের ৪ মাসে দেশ থেকে জনশক্তি রফতানি হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৩২১ জন। এর বিপরীতে রেমিট্যান্স এসেছে ১১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অর্থাৎ হাসিনা সরকারের আমলে ১২ মাসে যেখানে আসত ২১ বিলিয়ন ডলার, সেখানে বর্তমান সরকারের আমলে মাত্র ৪ মাসেই এসেছে ১১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স।
যা বলছেন জনশক্তি রফতানিকারক ও বিশ্লেষকরা
শ্রম বাজার বিশ্লেষক হাসান আহমদে চৌধুরী কীরণ সময়ের আলোকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নানাভাবে দেশের টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি মাধ্যম ছিল রেমিট্যান্সের টাকা দেশে না আনতে দেওয়া। এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল ইসলাম ৮টির বেশি ব্যাংকের মালিক ছিলেন। একইভাবে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদও ইউনাউটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মালিক। তারা তাদের ব্যাংকের ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে রেমিট্যান্সের অর্থ গায়েব করে ফেলত। তাদের মতো বিগত সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট অনেক ব্যবসায়ীও এ ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে রেমিট্যান্সের টাকা আটকে রাখত টাকা পাচারের জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে টাকা পাচার বন্ধ হওয়ায় রেমিট্যান্স আহরণের হার বেড়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে প্রবাসী আয় আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার চৌধুরী এ বিষয়ে সময়ের আলোকে বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে জনশক্তি রফতানি বাড়লেও রেমিট্যান্স না বাড়ার পেছনে হয়তো ব্যাংকের মালিকদের কোনো যোগসাজশ থাকতে পারে, সে বিষয়ে আমি বেশি কিছু বলতে পারব না। তবে বিগত বছরগুলোতে প্রবাসী শ্রমিকরা ফরমাল চ্যানেলের বাইরে ইনফরমাল চ্যানেলে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। কারণ সার্ভিসগুলো তাদের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়- এতে প্রবাসী শ্রমিকদের সুবিধা হয়। এ ছাড়া ওই সময় কার্ব মার্কেট আর ব্যাংকে ডলারের রেটে বেশ তফাত ছিল। এ কারণেও প্রবাসীরা বেশি লাভের আশায় বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে অবৈধ চ্যানেলে পাঠিয়েছেন। এ কারণেও সরকারি হিসাবে রেমিট্যান্স আহরণ কম আসত।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে একটিমাত্র বাজার খোলা রয়েছে বাংলাদেশের জন্য সেটি হচ্ছে- সৌদি আরব। এ দেশটিতেও শ্রমিক নেওয়ার ফ্লোটা কমে আসছে তাদের অভ্যন্তরীণ নানা নিয়মনীতির কারণে। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, মালয়েশিয়ার মতো বাজার বন্ধ রয়েছে। অল্প কিছুসংখ্যক শ্রমিক যাচ্ছে এসব দেশে। অথচ অন্য দেশ থেকে শ্রমিক ঠিকই নিচ্ছে তারা। এসব বাজার সম্প্রসারণের জন্য সরকারি পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করা দরকার। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকগুলো যত বেশি করা যাবে তত বাজার খুলতে সহায়ক হবে।
বর্তমানে রেমিট্যান্স বাড়ার আর কারণ
বর্তমানে জনশক্তি রফতানি কম হলেও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির আরও কিছু কারণ আছে বলে মত দেন বিশ্লেষকরা। যেমন- রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু অ্যাপস তৈরি করেছে। এসব অ্যাপসের মাধ্যমে টাকা আনতে ওইসব দেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশে বিকাশ বা নগদের মতো প্রতিষ্ঠানের ওয়ালেট ব্যবহার করে রেমিট্যান্স আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে বিদেশে থাকা কর্মীরা ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াও ওয়ালেটের মাধ্যমে সরাসরি অর্থ পাঠাতে পারছেন দেশে। এসব কারণে হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমেছে, আর হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমার কারণেও রেমিট্যান্স বেড়েছে। বিদেশি কর্মীরা এখন বৈধ চ্যানেলে বেশি অর্থ পাঠাচ্ছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স হাউসগুলোর অনিয়মও বন্ধ হয়েছে।
জনশক্তি রফতানি বাড়াতে করণীয়
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘জনশক্তি রফতানি ও প্রবাসী আয় বাড়াতে সবার আগে দক্ষী কর্মী গড়ে তুলতে হবে। এরপর মাইগ্রেশন ডিপ্লমেসি বাড়ানোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করতে হবে। একই সঙ্গে আমরা এখনও ইউরোপের শ্রমবাজারে পিছিয়ে আছি, ওই বড় বাজারটি ধরার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ইউরোপের তেদশগুলোতে এখনও অবৈধ পথে বা ভিন্ন কোনো দেশে আগে গিয়ে তার পর ইতালি, স্পেন বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে যাচ্ছে। এভাবে না গিয়ে বৈধপথে ইউরোপের বাজারে দক্ষ কর্মী পাঠাতে হবে। অল্প শ্রমে বেশি অর্থ উপার্জন করা যাবে- এমন কর্মী পাঠাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের দেশগুলোতে অনেক চিকিৎসকের চাহিদা রয়েছে, নার্সের চাহিদা রয়েছে। এর বাইরেও কারিগরিভাবে দক্ষ কর্মীরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ধরনের কর্মী বেশি বেশি যাতে পাঠানো যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।’