Originally posted in কালের কণ্ঠ on 7 May 2025
ব্যবসায় মন্দা, রাজস্বে ঘাটতি
ব্যবসা-বিনিয়োগে আস্থাহীনতা। উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে ধীরগতি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ। ব্যবসা প্রসার ও নতুন বিনিয়োগ নিয়ে নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষা।
সেই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে চাহিদা কমায় এর প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আয়ে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
পরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় তা কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। সে হিসাবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বছরে ৩৬৫ দিনের প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ২৭০ কোটি টাকা আদায় করতে হতো। তবে প্রথম ৯ মাসে আদায়ের ক্ষেত্রে বিরাট রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেওয়ায় তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যা আদায়ের কাছাকাছি যাওয়াকেও খুবই চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দিনপ্রতি আরো এক হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আদায় করা সম্ভব কি না, জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজস্ব মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে।
আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে, বড় ব্যবসায়ীরা অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য রেখে পালিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এটা তো স্বাভাবিক।’
সংস্থাটির তথ্য বলছে, ৯ মাসে মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। যদিও এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় ৯ মাসে মোট তিন লাখ ২২ হাজার ১৫২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল।
অর্থাৎ এখন বাকি তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে প্রতিদিন রাজস্ব আদায় করতে হবে দুই হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, যা অর্থবছরের দৈনিক গড় আদায়ের চেয়ে এক হাজার কোটি টাকা বেশি।
লক্ষ্য পূরণে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কর ফাঁকি রোধ, নন-কমপ্লায়েন্ট করদাতাদের নোটিশ দিয়ে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ের জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত বছরের তুলনায় মোটামুটি প্রবৃদ্ধি আছে। তবে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি যাওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং।’
আলোচ্য এ সময়ে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও আয়কর—এই তিন খাতের কোনোটিতেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তিন খাতেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে।
আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি হয়েছে আয়কর খাতে। এ খাতে ঘাটতি ২৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকার মতো। আয়কর খাতে ঘাটতির পেছনে মূল কারণ এই সময়ে আয়ের সুযোগই তৈরি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য সীমিত থাকায় এই খাতে তার প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া আমদানি কমে যাওয়ায় অগ্রিম আয়কর আদায়ও কমেছে। রাজস্ব আদায়ে বড় অবদান রাখে ভ্যাট খাত। আমদানি, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন, সরবরাহ, জোগানদার পর্যায় পর্যন্ত এই খাতের বিস্তৃতি। এর সর্বশেষ ধাপ ক্রেতা বা ভোক্তা। আমদানি, উৎপাদন, সরবরাহের পাশাপাশি উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে এই খাত বড় ধাক্কা খেয়েছে।
এ ছাড়া ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর আবগারি শুল্ক আদায় করে এনবিআর। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ কমায় আবগারি শুল্কেও পড়েছে এর প্রভাব। ভোগ কমে যাওয়ায় কমেছে উৎপাদনও। শিল্প কাঁচামাল ও পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক আদায়ে ঘাটতি দেখা গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমদানি সহজে বাড়বে না। কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়ায়ও এই খাতে আদায় কমেছে। যদিও এতে দেশের মানুষ উপকৃত হয়েছে।
জুলাই মাসের শুরু থেকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়। তখন প্রায় সব কিছু বন্ধ ছিল বললেই চলে। সাধারণ ছুটির পাশাপাশি কারফিউও ছিল বেশ কয়েক দিন। এসবের প্রভাব পড়েছে শুল্ক-কর আদায়ে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকার পরিবর্তনের পরও আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, যার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে ত্রুটি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বেশ কিছু খাতে নতুন করে করছাড়, আমদানি কমে যাওয়াই রাজস্ব ঘাটতির মূল কারণ। তবে এই সমস্যা মূলত কাঠামোগত। কর ফাঁকি রোধে বেশি উন্নতি হয়নি। পরামর্শক কমিটির সুপারিশকে ভিন্নভাবে এনে ক্যাডারভিত্তিক করায় একটা দোটানা তৈরি হয়েছে। সংস্কারপ্রক্রিয়াও ধাক্কা খেয়েছে। এখন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন মাথায় রেখে পর্যায়ক্রমে করছাড় কমিয়ে আনা, দুর্নীতি রোধ করা, সম্পত্তিসহ যেসব জায়গা থেকে কর আদায় হয় না সেখান থেকে আদায় করা এবং বিভিন্ন ডেটাবেইস একসঙ্গে করতে হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা দ্রুত একটা রাজনৈতিক সরকার ব্যবস্থা চায়। অন্তর্বর্তী সরকার কখনোই স্থায়ী সমাধান নয়। তাদের পক্ষে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের আস্থা আছে রাজনৈতিক সরকারের প্রতি। রাজনৈতিক সরকারের একটা স্থায়ীত্ব আছে। এ কারণেই ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক সরকার চায়।’