Originally posted in BD Digest on 14 May 2025
১০ মাসে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা, কলমবিরতিতে দিনে ক্ষতি ১২শ কোটি
চলতি অর্থবছরের ১০ মাস না যেতেই জাতীয় রাজস্ব ঘাটতির অঙ্ক ৭২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে। দেশের অর্থনীতি যখন চরম স্থবিরতার মধ্যে রয়েছে, ঠিক তখনই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিভক্তির সরকারি সিদ্ধান্তে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ। এর জেরে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘কলমবিরতি’ কর্মসূচি পালন করছেন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হওয়ায় আগামী বাজেট ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবায়ন মারাত্মক চাপে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এর আগের মাসে এই ঘাটতির অঙ্ক ছিল ৬৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ এক মাসে ঘাটতি বেড়েছে ৫ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। সরকার শুরুতে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামানো হলেও আদায়ের বাস্তবতা তা থেকেও অনেক দূরে রয়ে গেছে।
বর্তমান গতি অনুযায়ী দৈনিক গড়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে না পারলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে উঠবে। অথচ রাজস্ব আদায়ের যে ধীর গতি চলছে, তাতে এই গড় অঙ্ক দ্বিগুণ করার প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এতে বাজেট বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন অনিশ্চয়তায় পড়বে।
এর মধ্যে রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতা আরও ঘনীভূত হয়েছে এনবিআর বিভক্তি নিয়ে তৈরি হওয়া অস্থিরতায়। সম্প্রতি সরকার একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআরকে বিভক্ত করে পৃথক নীতিনির্ধারণী ও আদায়কারী সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এনবিআরের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, বা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কোনো আলোচনাবিহীনভাবে এবং কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই। তারা এটিকে ‘বিশেষ মহলের চাপের ফসল’ বলে অভিহিত করেছেন।
আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের ভাষ্য, গভীর রাতে গোপনে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং নিয়ম-নীতি উপেক্ষার দৃষ্টান্ত। এতে শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মানসিক চাপই তৈরি হয়নি, বরং এনবিআরের দীর্ঘস্থায়ী কাঠামো ও ‘চেইন অব কমান্ড’ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে রাজস্ব সংগ্রহের প্রতিটি ধাপে।
‘কলমবিরতি’র কারণে গত তিন দিনে আনুমানিক ৩ হাজার ৮১০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের আশঙ্কা, এনবিআরকে এভাবে ভেঙে ফেলা হলে রাজস্ব সংগ্রহের প্রতিষ্ঠিত কাঠামো ভেঙে পড়বে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে।
বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক দেশেই নীতিনির্ধারণী ও রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা আলাদা থাকলেও, সেখানে এই ধরনের পরিবর্তনের আগে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা, অংশীজনের মতামত এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে তা অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি এনবিআর সংস্কার সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির সুপারিশও উপেক্ষা করা হয়েছে। কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তারাও এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আগে থেকে অবহিত ছিলেন না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বিভক্ত করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে ঘিরে রাজস্ব প্রশাসনে অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজস্ব বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সংস্কার প্রয়োজন হলেও তা হওয়া উচিত ছিল সুসমন্বিত ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে—না হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “নীতিগতভাবে এনবিআরকে আলাদা দুটি সংস্থায় ভাগ করা সম্ভব, তবে তা হঠাৎ করে নয়—পরিকল্পিত ও পরিপক্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে হওয়া উচিত ছিল। এমন একটি সিদ্ধান্ত এমন সময়ে এসেছে যখন রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছে এবং বাজেট প্রস্তুতির সময় ঘনিয়ে এসেছে। এতে করে প্রশাসনে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সংস্কার অবশ্যই দরকার, কিন্তু অংশীজনদের বাইরে রেখে তা করাটা ঝুঁকিপূর্ণ।”
তিনি আরও বলেন, “এই সিদ্ধান্তটি কোনো চাপের ফল কি না, সেটিও যাচাই করা উচিত। রাতারাতি অধ্যাদেশ জারি করে এমন বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন আনা নীতিগতভাবে দুর্বলতা নির্দেশ করে।”
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, “এই সময়টা রাজস্ব ও বাজেট প্রস্তুতির গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম। এমন সময়ে এনবিআর বিভক্তি নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। সংকট নিরসনে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আলোচনায় বসতে হবে।”
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক—তিনটি বড় খাতেই রাজস্ব ঘাটতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা গেছে আয়কর খাতে, যার পরিমাণ প্রায় ২৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। আমদানি হ্রাস পাওয়ায় অগ্রিম কর আদায় কমেছে। একই সঙ্গে উৎপাদন ও সরবরাহ সংকটে ভ্যাট আদায় ব্যাহত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ব্যাংকে আমানত হ্রাস পেয়ে আবগারি শুল্ক থেকেও রাজস্ব প্রত্যাশিত মাত্রায় আসেনি।
পাশাপাশি, জনস্বার্থে কিছু পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়ার ফলে আমদানি শুল্ক আয়েও হ্রাস এসেছে। যদিও এতে ভোক্তারা উপকৃত হয়েছেন, তবুও সামষ্টিক রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান স্বীকার করেন, “রাজস্ব আদায় সরাসরি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে বিনিয়োগ কমেছে, ব্যবসায়ীরা কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছেন। এসব কারণে রাজস্ব সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।”
তিনি আরও জানান, কর ফাঁকি রোধ ও করদাতাদের নন-কমপ্লায়েন্স শনাক্তে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই প্রবণতা চলতে থাকলে সামনের বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের আস্থা হারাতে পারে সরকার। রাজস্ব ঘাটতির প্রভাব শুধু বাজেটে সীমাবদ্ধ থাকবে না, উন্নয়ন প্রকল্প ও পুরো অর্থনীতিতেই পড়বে।
তাদের মতে, রাজস্ব খাতে কাঠামোগত সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তা হতে হবে অংশীজনদের পরামর্শ ও পূর্ণাঙ্গ গবেষণার ভিত্তিতে। অন্যথায়, এই সিদ্ধান্ত আর্থিক ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি করতে পারে, যা মোকাবিলা করা হবে অত্যন্ত কঠিন।