আসন্ন বাজেটে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in Dhaka Mail on 14 May 2025

মূল্যস্ফীতির আগুনের আঁচ রান্নাঘরে!

গত মার্চ মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮.৯৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, এই মূল্যস্ফীতির মধ্যে শুধু খাদ্যদ্রব্যের প্রভাব ৪২.৭১ শতাংশ। যেখানে আবার ৩৪.১৪ শতাংশই চালের। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক মূল্যস্ফীতির উৎস হচ্ছে খাদ্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি।

মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত খাদ্যপণ্যের মূল্য। প্রতিদিনের চাল-ডাল-তরকারি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস, সবই এখন মধ্যবিত্তের জন্য ‘আধা বিলাস’ পণ্যে পরিণত হয়েছে। গরিবের জন্য তো চিত্র আরও করুণ।

মূল্যস্ফীতিতে খাদ্যদ্রব্যের যে অবদান

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের একটি পর্যবেক্ষণ বলছে, রমজানের পরপরই চাল, ডাল, তেল, মাছ ও সবজি, সব শ্রেণির খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। যার প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। দেশের মূল্যস্ফীতিতে খাবারের পরপরই রয়েছে ঘর ভাড়ার খরচ। যেখানে ১৩.০৯ শতাংশ প্রভাব ঘর ভাড়ার, পোশাকে ৯.৩৭ শতাংশ, ধুমপান ও অ্যালকোহলে ৭.৪৭ শতাংশ, পরিবহনে ৬.৪০ শতাংশ, শিক্ষায় ৩.৮৩ শতাংশ ও ফার্নিচারে ৩.৬২ শতাংশ।

এদিকে খাবারের মধ্যে মাঝারি মানের চালের প্রভাব ১৬.৭৩ শতাংশ, ইলিশ মাছ ১১.৩৭ শতাংশ, বেগুন ও আলু ১০-১২ শতাংশ, ভোজ্যতেল ৯ শতাংশ এবং মুরগির মাংস ৮.৫ শতাংশ প্রভাব রাখছে। এছাড়া খুচরা বাজারে খেজুর, চিনি ও আটা-পণ্যের মূল্যও অতিরিক্ত বেড়েছে। সবমিলিয়ে সাধারণ মানুষের খাদ্য ব্যয় বেড়েছে।

মূল্যস্ফীতির কারণে ধুঁকছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো

শুধু নগরাঞ্চল নয়, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি গ্রামের মানুষের জীবনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। শহরাঞ্চলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। বিশেষ করে যেসব পরিবারে একাধিক সন্তান রয়েছে। তাদের মাসিক খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা এখন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রাজধানীতে আয়ের একটা বড় অংশই চলে যাচ্ছে ঘর ভাড়ার পেছনে।

সাধারণ মানুষ বলছে, রমজান মাসে খাদ্যপণ্যের দাম অনেকটাই স্বাভাবিকে এসেছিল। কিন্তু রমজান শেষ হতেই পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হতে শুরু করে।

মোহাম্মদপুর এলাকার গৃহবধূ লাকী আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রমজান মাসটা আমাদের জন্য অনেক স্বস্তির ছিল। ঢাকা শহরে একজনের আয় দিয়ে ভাড়া বাসায় থেকে সব খরচ মেটানো অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। একারণে দেখা যাচ্ছে, খাদ্যপণ্যেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে। আবার ঘরে শিশু বাচ্চা আছে। শিশু খাদ্যের জন্য মাঝেমধ্যে ধারও করতে হচ্ছে। যা জীবনযাপনকে কষ্টদায়ক করছে।’

রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা আসাদুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রমজানে যে স্বস্তিটা পেয়েছি, এখন বাজারে তার উল্টো চিত্র। বাবা গ্রামে তেমন আয় করতে পারেন না। আমার উপার্জনের কিছু অংশ বাবা-মাকে পাঠাতে হয়। আবার শহরে নিজের সংসার। সবমিলিয়ে টানাপোড়নেই দিন যাচ্ছে।’

রাজশাহীর তেরখাদিয়া এলাকার গৃহবধূ তারা বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একজনের আয়ে তিনজনের সংসার। এরমধ্যে মূল উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমার স্বামী গত কয়েক মাস ধরে বিছানায় পড়ে আছে। সঞ্চয় যা ছিল তাও শেষ। এখন বাধ্য হয়ে রুমের সঙ্গে টং দোকান দিয়েছি। আয় যা হয় তা দিয়ে খাওয়া-পরায় টান। স্বামীর চিকিৎসা পদ্ধতিও বদলাতে হয়েছে। দাম কম থাকলে মাছ-মাংস হয়তো পাতে উঠত। এখন সবজিটাও পাত থেকে কমে গেছে। সবমিলিয়ে জীবন দুর্বিসহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসারে এখন এমন অবস্থা চাল কিনলে ডাল কেনার টাকা থাকে না।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার উপরে একটা বড় চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এটার সঙ্গে পাল্টা দিয়ে মজুরিও বাড়তে হবে। তখন প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপরেও একটা প্রভাব পড়ে। আমরা দেখছি, মজুরি বাড়েনি। তার মানে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। সব মিলেয়ে বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এটা নিয়ে সরকার রাজস্ব ও মুদ্রানীতি দুইটা দিয়েই চেষ্টা করছে। রাজস্ব নীতিতে কিছু পরিবর্তন আসছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমেও চেষ্টা করা হচ্ছে।’

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আগামীতে বাজেট আসছে, সেখানে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের বিষয়টিও ভাবতে হবে। বাজার পলিসিটাকে আরও উন্নত করতে হবে। এক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং সিস্টেমও শক্তিশালী করতে হবে। তারচেয়েও বড় কথা, সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকলে তখন মূল্যস্থীতিতে চাপ বৃদ্ধি পায়। সেজন্য সময়মতো আমদানি করা, স্টক স্বাভাবিক রাখাসহ সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর দিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। এছাড়া ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান তৈরি করে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও নজর দিতে হবে।’