Originally posted in প্রথম আলো on 19 July 2025

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা স্বৈরাচারকে সরালাম। কিন্তু এখনো নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গায় সংকুচিত অনুভব করি।’
আজ শনিবার ‘কেলেঙ্কারির অর্থনীতি’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে এসব কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি আরও বলেন, এটি সময়োপযোগী একটি কাজ এবং অর্থনৈতিক সাংবাদিকতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বইটি প্রাসঙ্গিক ও সমসাময়িক।
বইটি লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন মাসুম। বইটি প্রকাশ করেছেন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। এই প্রকাশনী সংস্থার কার্যালয়ে এই অনুষ্ঠান হয়।
রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণ ও অবৈধ অর্থের যে প্রতিপত্তি তৈরি করা হয়েছে। ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুণ্ঠনের মাধ্যমে যে বিশাল লুটেরা ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠেছে—এই বইটিতে এর চিত্র উঠেছে।
প্রকাশ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শারমিন্দ নীলোর্মি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গ্লোবাল সেন্টার ফর ইনোভেশন অ্যান্ড লার্নিংয়ের উপদেষ্টা রাদিয়া তামিম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন।
অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র ও মালিকপক্ষকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আগে পাঠক কূল এত উগ্র ও আগ্রাসী ছিলেন না। পাঠককুলের মধ্যে ক্ষুদ্র ও অতি উচ্চ স্বরের এক শ্রেণি আছেন, যাঁরা এখন গণমাধ্যম বন্ধ করতে দিতে চান।
বইয়ের লেখক সম্পর্কে বলেন তিনি বলেন, লেখকের লেখায় ছিল তথ্যের দায়বদ্ধতা এবং সাহিত্যরস। তার লেখা বইয়ের শিরোনাম কেলেঙ্কারির অর্থনীতি প্রথমে পড়েই ভেবেছিলাম, এটি বুঝি ‘কলঙ্কিত অর্থনীতিবিদ’! পরে বুঝলাম—এটি সময়োপযোগী একটি কাজ এবং অর্থনৈতিক সাংবাদিকতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বইটি প্রাসঙ্গিক ও সমসাময়িক। প্রকাশক দায়িত্ববোধ থেকেই বইটি বের করেছেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, গত এক বছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ওএমএসে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করা হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে কিছুটা স্বস্তি দিতে শহরে মানুষকে সুরক্ষা বেশি দেওয়া হয়েছে। গ্রামের মানুষের প্রতি নজর কম ছিল। দেশ আসলে সবার নয়। ক্ষমতায় যে থাকে তাদের। প্রশ্ন হলো আপনি কার পক্ষে কথা বলবেন? যে পিছিয়ে আছেন, তার পক্ষে।
নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এই দুটি প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের আগ্রহ নেই। তিনি মনে করেন, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে একটি সংস্কার বিরোধী জোট হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না। ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসতে চায়, ওই সব রাজনৈতিক দলকে অর্থনৈতিক চলকগুলো নিয়ে তাদের চিন্তা–ভাবনা জনগণের সামনে পরিষ্কার করা উচিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শারমিন্দ নীলোর্মির মতে, যাঁরা অর্থনীতির ছাত্র নন, দৈনন্দিন জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাঁদের জন্য এই বইটি পঠনযোগ্য। এই বইয়ের নাম ‘গৌরী সেনের অর্থনীতি’ হতে পারত। এই যুগে জগৎ শেঠ কীভাবে তৈরি হয়, তা লেখক দেখিয়েছেন।
শারমিন্দ নীলোর্মি আরও বলেন, এ বইয়ে অর্থনীতির কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম এসেছে। কিন্তু হুকুমের আসামিদের নাম আসেনি। বুদ্ধিভিত্তিক দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারিকে ক্রমাগত ন্যায্যতা দিয়ে গেছে।
অনুষ্ঠানে গত কয়েক দশকে ব্যাংক, শেয়ারবাজারসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে দেশে কীভাবে লুটপাট হয়েছে, এর কিছু উদাহরণ তুলে ধরেন লেখক শওকত হোসেন মাসুম। অনুষ্ঠানের শেষ অংশে প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন সুমিত্র কুমার মুৎসুদ্দী, তানভীর হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক মাসুদ কামাল, জাকির হোসেন, প্রণব মজুমদার, প্রমুখ।
এদিকে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের ফেসবুকে পেজে লেখা হয়েছে, অর্থনীতি কেলেঙ্কারিময় হলে রাষ্ট্র ও সমাজ কতটা বিপদগ্রস্ত হয়, কেলেঙ্কারির অর্থনীতি বইটির পড়লে সেটি বিশদে বোঝা যাবে। রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণ ও অবৈধ অর্থের যে প্রতিপত্তি তৈরি করা হয়েছে। ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুণ্ঠনের মাধ্যমে যে বিশাল লুটেরা ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠেছে—এই গ্রন্থটি তারই একটি প্রামাণিক বিবরণ। শওকত হোসেন মাসুম দীর্ঘদিন গণমাধ্যমে অর্থনীতি বিষয়ে সাংবাদিকতা করেছেন। তাঁর নিজস্ব অনুসন্ধান ও গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া প্রতিবেদনগুলোকে গ্রন্থাকারে রূপ দেওয়া হয়েছে কেলেঙ্কারির অর্থনীতি গ্রন্থে।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনই শুধু নয়, সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্র, হাইকোর্টের রায় এবং বিভিন্ন গ্রন্থের বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা উপস্থাপনের মাধ্যমে লেখক বইটিকে সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। সদ্য পতিত সরকারের দুর্নীতির সাম্প্রতিক বিবরণ যুক্ত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক কেলেঙ্কারির সময়টির একটি বিস্তারিত পর্যালোচনা এ বইটিতে উঠে এসেছে।